প্রফেসর মো: ইসরারুল হক
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে লুটেরা পুঁজির উত্থান ও বিকাশ
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের আগেই দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর চাপে দেশে ব্যক্তিখাতকে উৎসাহিত করার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। ৭৫’ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মাধ্যমে তৎকালীন সরকার স্বজনতোষী পুঁজিবাদকে (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ফিরেয়ে এনেছিল। ১৯৮২ সালে প্রবর্তিত সংশোধিত শিল্প নীতি ও আমদানী উদারীকরণ নীতি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের প্রয়াস। আশির দশকে বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত বিন্যাস কর্মসূচি, নিউ লিবারেল নীতিমালা সংস্কারের ধারাবাহিকতাকে জোরদার করার জন্যই পরিচালিত হয়েছিল।
আমদানি উদারীকরণ, বিরাষ্ট্রীকরণ, ব্যক্তিখাতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস, অর্থনীতিতে সরকারি ভূমিকার সংকোচন এবং বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ তাদের প্রেসক্রিপশনের মূল ধারা ছিল। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এদেশে নয়া উদারবাদ অর্থনীতির গতি আরো ত্বরান্বিত হয়। নব্বই দশকের শুরুতে আওয়ামী লীগ মুক্ত বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠাকে তাদের রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে ঘোষণা করে। নয়া উদারবাদী অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে সব ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করেছে তা হল (১) বৈষম্য- অসমতা প্রকট থেকে প্রকটতর করেছে।(২) কর্পোরেট দুর্নীতি বৃদ্ধি করেছে। (৩)গণতন্ত্রের বিকাশ রুদ্ধ করেছে(৪) বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ বিষয়টি দেশের মহাবিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৭২ সালে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় খাতে জাতীয় সম্পদের যে বিপুল সমাবেশ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কিছুদিনের মধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ত কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে তা লুটপাট করতে শুরু করেছিল দুর্নীতিবাজ ও লুটেরারা। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে পুঁজি লুন্ঠনের হোতা ছিল ব্রিফকেসধারী বা ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকাররা। ১৯৭৩ সাল থেকে লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও অদক্ষতা, অরাজকতা, উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিক রাজনীতির ফলে লোকসানে পর্যবসিত হল প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান।
বৈদেশিক অনুদান ও রিলিফ লোপাট করতে শুরু করে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল। রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য সংস্থা টিসিবি এবং সেবাসংস্থা রেডক্রসও পরিণত হল লুটপাটের প্রতীকে।
এভাবে দলীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং আমলা যোগসাজশে দুর্নীতিবাজ ও পুঁজি লুটেরারা পুঁজিপতি বনে গেল। আওয়ামীলীগের অভ্যন্তরে ক্রমশঃ শক্তিশালী হয়ে উঠা পুঁজিবাদী লবি দিন দিন শক্তিশালী হতে শুরু করলো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই দুর্নীতিবাজ ও পুঁজিলুটেরা গোষ্ঠিগুলোর বিকাশ শুরু হয়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পথ ধরে বাংলাদেশে আবারো প্রতিষ্ঠিত হলো পুরোনো পাকিস্তানি কায়দায় সামরিক বাহিনী ও সিভিল আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত নব্য উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজি লুন্ঠন মূলক রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা।
পুঁজিবাদের বিশ্বহোতা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠল এসব নব্য পুঁজিপতির। সাম্রাজ্যবাদের মোড়লরা খোলাখুলি নেমে পড়ল এদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির মোড় পরিবর্তনের খেলায়। বৈদেশিক সাহায্যের বন্যা বইতে শুরু করল।
স্বাধীনতা উত্তর এদেশের কয়েক লাখ ব্যবসা-নির্ভর পুঁজিপতি, মার্জিন আত্মসাৎকারী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, দুর্নীতিবাজ, আমলা, সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদার এবং বৈদেশিক সহায়তার পাইপলাইনের ঘাটে ঘাটে সুবিধা ভোগীরাই যে নব্য ঔপনিবেশিক, প্রান্তীয় পুঁজিবাদী, আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজি লুন্ঠণমূলক চরিত্রের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ধনাঢ্য ও উচ্চবিত্ত গোষ্ঠি এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত গোষ্ঠির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। অতএব তাদের সিংহভাগই যে প্রকৃত বিচারে মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।বাংলাদেশে রাজনীতিক, সামরিক, বেসামরিক আমলাতন্ত্র, মুৎসুদ্দি পুঁজিপতি-এই চার গোষ্ঠির সম্মিলিত জোট রাষ্ট্র ক্ষমতা ও অর্থনীতিকে একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা পুঁজি আহরণের লোভনীয় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এদেশের রাষ্ট্র উৎপাদনশীল জনগণের স্বার্থের পাহারাদার না হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী ঐ সম্মিলিত গোষ্ঠির দুর্নীতি এবং মুনাফা আহরণের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
এসেমগলু ও রবিনসন এ ধরণের রাষ্ট্রকেই পুঁজি লুন্ঠনমূলক রাষ্ট্র বলে অভিহিত করছেন। অথচ নয়া উদারবাদী বাজার মৌলবাদী কাঠামোগত বিন্যাস কর্মসূচির প্রেসক্রিপশন অনুসারে আশির দশক থেকে উৎপাদন ও বন্টন থেকে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে গুটিয়ে নিয়ে মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করায় অর্থনীতিতে গত চারদশকে অনেকগুলো ক্ষতিকর অভিঘাত সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে লুটেরা পুঁজির বিকাশ হয়েছে প্রধানত ব্যাংকের ঋণ লুণ্ঠনের মাধ্যমে। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠন ছিল বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময় নিয়মিত ঘটনা। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের ১৫ বছরে ব্যাংক লুন্ঠনের ক্ষেত্রে যেসব সাধারণ প্রবণতা ও পদ্ধতি শনাক্ত করা যায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- সরকারি জালিয়াতির মাধ্যমে লুন্ঠন, ঋণ নিয়ে ব্যবসার পুঁজি গঠন, ঋণ খেলাপ ও লুটপাট, ব্যাংক মালিক হয়ে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, ব্যাংকের টাকা লুটে ব্যাংক মালিক হওয়া, ব্যাংক লুটে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা যেমন-অনিয়ম, দুর্নীতির প্রশ্রয় প্রদান, লুণ্ঠনের হোতাদের বিচার না করা, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার না করা ইত্যাদি।
বিশ্বব্যাপি কালো টাকা নিয়ে কাজ করেন অস্ট্রিয়ার অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ফ্রেডারিক স্লেইডার। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের কালো টাকার পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৩৪ শতাংশ। টাকার অঙ্কে হিসাব করলে তা হয় পৌনে চার লাখ কোটি টাকা। এই কালো টাকা সৃষ্টি হচ্ছে, ঘুষ, অবৈধ কমিশন ও পক্ষপাতদুষ্ট মুনাফা ইত্যাদির মাধ্যমে। রাজনেতিক ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে এই কালো গোষ্ঠি। এই অবৈধ আয়ের আরেকটি বড় উৎস এখন মেগা প্রকল্প। যাকে আজকাল বলা হয় স্বজনতোষী পুঁজিবাদ বা ক্রোনি ক্যাপিটালিজম।
(সূত্র: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সেমিনারে রচিত মূলপ্রবন্ধ, “বাংলাদেশে আয় ও ধন বৈষম্য”-৭ সেপ্টেবর ২০১৯ )
সংকটের আবর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি
বিগত ১৫ বছরে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকার মেগা উন্নয়ন প্রকল্প, অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছ আয় বৃদ্ধির বয়ান দিয়ে বাজারি শোষন, সীমাহীন মূল্যস্ফীতি, অর্থনেতিক দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট ও বিদেশে পাচার, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
অনিয়ন্ত্রিত বাজার ও মুদ্রাস্ফীতি
বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে কতিপয় সিন্ডিকেটের দৌরাত্মে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। ফলে চাল, আটা, তেল, চিনি,ডিম, মাছ-মাংস, এমনকি জীবন রক্ষাকারী ঔষধের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী ১০টি সিন্ডিকেটের আধিপত্য বেড়ে চলেছে। সরকার দাম বেঁধে দিয়েও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এই ১০টি বৃহৎ গোষ্ঠির (এস আলম, সিটি, মেঘনা, টিকে, দেশবন্ধু, আব্দুল মোনেম, কাজী ফার্মস, আফতার ফার্মস, সিপি বাংলাদেশ এবং প্যারা সন পোলট্রি) একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা। চাঁদাবাজির কারণে ও ৩০ শতাংশ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। গত ১৩ মে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হাল নাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। গত এপ্রিলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭৪ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৭৬ শতাংশ। বিবিএস এর তথ্য অনুযায়ী গত অক্টোবর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০.৮৭ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২.৬৬ শতাংশ হয়েছে এবং নভেম্বর মাসে খাদ্যমূল্য স্ফীতি বেড়ে ১৩.৮০ শতাংশ এবং সার্বিক মূল্য স্ফীতি ১১.৩৮ শতাংশ হয়েছে। গত দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন অর্থনীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির এই হার কমিয়ে আনতে ১০-১৫ মাস সময় লাগবে। গত দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম। সবশেষ গত এপ্রিল মাসে জাতীয় মজুরির হার ছিল ৭.৮৫ শতাংশ, আর মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭৪ শতাংশ। দেশের ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এমন কর্মজীবি মানুষের সংখ্যা ৬ কোটির মতো । মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম হলে নিম্ন আয়ের মানুষেরা বেশি চাপে থাকে। তাদের সংসার চালাতে খরচ কাট ছাঁট করতে হয়। জীবন যাত্রার মান কমে যায়|
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই পরিস্থিতিতে একটি সমীক্ষায় দেশের খাদ্য পরিস্থিতির একটি আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে ২ কোটি ৩৬ লাখ বা ২৬% মানুষ উচ্চ মাত্রার খাদ্য সংকটে ভুগছেন।
ডব্লিউ এফ পি গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব নিয়ে আরেকটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে গত ফেব্রুয়ারীতে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ মানুষ খাদ্য ঝুঁকিতে ছিল, দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ৪৩ শতাংশ মানুষ বাকিতে
খাবার কিনছে। ২২ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বাবদ খরচ কমিয়েছে। আর ১৩ শতাংশ মানুষ সঞ্চয় ভাঙছে। । দ্রব্যমূল্যের উদ্ধগতির কারণে দেশে দারিদ্র ও ক্ষুধার ঝুঁকি বেড়েছে অথচ তার প্রতিকারে অন্তবতীকালিন সরকার কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না । তাহলে কি অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের অভিযোগই সত্য যে সরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে যতটা গুরুত্ব দিচ্ছে ,অথনৈতিক সংস্কারকে ততটা দিচ্ছে না ।
বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকার ৯ জানুয়ারি চলতি ২০২৪-২৫ বছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবার উপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে এক অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করেছে। এই অধ্যাদেশে শতাধিক পণ্য ও সেবার উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়বে। অবশ্য ২২ জানুয়ারী ৮ টি পণ্য ও সেবার উপর শুল্ক প্রত্যাহার করলেও বাকি পণ্য ও সেবার উপর ভ্যাট ও শুল্ক অব্যাহত রেখেছে।পণ্য ও সেবার উপর ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধিতে একদিকে দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে অন্যদিকে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি করবে। বিগত সরকারের মতো বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকার ও ধনী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায় জোরদার করার বদলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আর ও বেশি করে পরোক্ষ কর আদায়ের পথে হাঁটছে। তারা কর ফাঁকি রোধ ও বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধারে জোর দেওয়ার বদলে অগণতান্ত্রিক কায়দায় আই এম এফের শর্ত মেনে ভ্যাট বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা আদায়ের সহজ রাস্তা বেছে নিয়েছে। শুল্ক কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে সরকারের মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় কোন সঠিক সমন্বয় নেই। এই ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ করের বদলে ধনিক গোষ্ঠীর আয় ও সম্পদ থেকে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে।
(সূত্র: ১৩,১৪,১৭, ২১ মে-২০২৪, ১২ জানুয়ারি ২০২৫ দৈনিক প্রথম আলো)
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে ৪ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি মনে করে উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তার কারণে এদেশে বিনিয়োগ ও শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি দুর্বল হবে এবং সাম্প্রতিক বন্যার ফলে কৃষিতে মাঝারি মানের প্রবৃদ্ধি হবে। বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট অক্টোবর ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে ৩.২ শতাংশ থেকে ৫.২ শতাংশের মধ্যে থাকবে। তবে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৪ শতাংশ। এর আগে গত এপ্রিলে বিশ্ব ব্যাংক চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বাভাস দিয়েছিল।
মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে প্রত্যাশা করছে বিশ্বব্যাংক । সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তার ফলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এক্ষেত্রে আর্থিক খাতে সংস্কার, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, রাজস্ব বাড়ানোর পদক্ষেপ, ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি ও বাণিজ্য চাঙ্গা হওয়ার বিষয়গুলোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
(সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো )
কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি ও বেকারত্ব
বিগত সরকারের আমলে ব্যয় বহুল অবকাঠামো নির্ভর এমন এক অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছে, যেখানে কাগজ-কলমে প্রবৃদ্ধি হয়েছে কিন্তু তাতে দেশে তরুণদের যথেষ্ট ও মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান হয়নি। বিবিএসের ত্রৈমাসিক
শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ (জানুয়ারী-মার্চ) অনুসারে বেকারের হার মোট শ্রম শক্তির ৩.৫১ শতাংশ বা ২৫ লাখ ৯০ হাজার দেখানো হলেও বাস্তবে বেকারের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
দেশে বেকারত্বের অনুপাত সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর স্যাম্পল ভাইটাল সট্যাটিসটিকস জরিপ থেকে। ২০২৩ সালের জরিপ অনুসারে, দেশের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের ৩৯.৮৮ শতাংশ বা ১ কোটি ২৮ লাখ পড়ালেখা বা কাজ কোনো কিছুর সঙ্গেই যুক্ত নন, যা দেশে তরুণদের বেকারত্বের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। বেকার তরুণদের ভেতর আবার উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় ও সমপর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার ১২ শতাংশ। আবার স্বল্প শিক্ষিতদের কর্মসংস্থান হলে ও সেটা মূলত অনানুষ্ঠানিক খাতে অতি নিম্ন মজুরির হওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ পথে অভিবাসী হওয়ার হার বেড়ে চলেছে। ভূমধ্য সাগরের ঝুঁকিপূর্ণ পথে নৌকায় করে ইতালি গামী বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। ২০১৯ সালে এই পথে অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে বাংলাদেশের হার ছিল ৫ শতাংশ, ২০২১ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশ এবং ২০২২ সালের শেষে তা ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
( সূত্র: সর্বজন কথা, নভেম্বর ২০২৪ )
অর্থনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন ও অর্থ পাচার
২০০৯ সালে ক্ষমতাগ্রহনের পর থেকেই হাসিনা দেশটাকে তার সাম্রাজ্য হিসেবে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করার মিশনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা, তার আত্মীয় স্বজন ও তার পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত ব্যবসায়ী লুটেরা ধনিকশ্রেণী। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতি মন্ত্রী সোহেল তাজ অভিযোগ করেছেন ২০০৯ সালেই শেখ হাসিনা বলেছিলেন বিএন পি অনেক টাকা কামিয়েছে এখন আমাদের দুই হাতে টাকা কামাতে হবে।
প্রধানত উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পুঁজি লুন্ঠনকে হাসিনা সবচেয়ে বেশি আর্কষণীয় হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। হাসিনা তার ১৫ বছরের শাসনামলে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ মাধ্যমে তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী, কতিপয় অলগার্কি ব্যবসায়ী ও পুঁজি লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারী খাতের প্রকল্প থেকে কোটি টাকা কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। সম্প্রতি একটি মার্কিন গণমাধ্যম গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প দাবী করেছে যে, শেখ হাসিনা তার ছেলে জয় এবং শেখ রেহেনার মেয়ে টিউলিপের মধ্যস্থতায় এবং একটি মালয়েশিয়ান ব্যাংকের সহায়তায় রূপপুর প্রকল্প থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করেছেন।
উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা চাঁদাবাজি ঘুষ এবং বাড়তি খরচ দেখিয়ে লুটপাট করেছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও সুবিধা ভোগীরা। গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে খরচ হয়েছে ৭ লক্ষ ২০ হাজার কোটি টাকা। এর ৪০ শতাংশ পর্যন্ত টাকা লুটপাট করা হয়েছে । ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত সেবা খাতে দুর্নীতি জরিপ ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সেবা খাতে জাতীয় পর্যায়ে মোট ঘুষের পরিমাণ এক লক্ষ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। টিআইবির জরিপের তথ্য বলছে সেবা খাত গুলোর গড় দুর্নীতির হার প্রায় ৭১ শতাংশ। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম অবজারভার ও বার্লিন ভিত্তিক দুর্নীতি বিরোধী
প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে বলা হয়েছে শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান এর যুক্তরাজ্যে বিপুল সম্পদের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ৩০০ টির বেশি বাড়ি ও সম্পদ রয়েছে এগুলোর মূল্য অন্তত ১৬০ মিলিয়ন পাউন্ড নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের ৩ কোটি ৮০ লক্ষ পাউন্ডের পাঁচটি সম্পদ ও আহমেদ আকবর সোবহান এর পরিবারের ১ কোটি ৩০ লক্ষ পাউন্ডের দুটি সম্পদ রয়েছে। এছাড়া ও বিগত সরকারের আর্শীবাদ পুষ্ঠ এস আলম ৭ টি ব্যাংকের মালিকানা দখল করে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে ২ লক্ষ কোটি টাকা এবং সালমান এফ রহমান প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি রিপোর্টার্স এবং কিছু নির্দিষ্ট পূর্বানুমানের ভিত্তিতে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের হিসাব করেছে অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা হিসেবে এর পরিমাণে ২৮ লক্ষ কোটি টাকা। এই হিসেবে প্রতিবছর গড়ে ১ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা , রাজনীতিবিদ , ব্যবসায়ী , আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল (ক্রীড়ানক)ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থ পাচার করছেন। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি মনে করে প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৪ শতাংশের পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। এছাড়া ২০২৩ ২০২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ও প্রবাস থেকে যত অর্থ এসেছে এর এক পঞ্চমাংশ পরিমাণ অর্থ এক বছরে পাচার হয়। বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ হিসেবে যত অর্থ আসে এর দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ পাচার হয়।
অর্থ পাচার নিয়ে গবেষণা করে এমন কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ধৃতি দিয়ে শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বলা হয় দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ৫৩২টি বাড়ি বা সম্পদ আছে যার মূল্য সাড়ে ৩৭ কোটি ডলার।
২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৩ হাজার ৬০০ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে মনোনীত হয়েছেন। ২০২৩ সালে ইউ ট্যাক্স অবজার ভেটরি প্রতিবেদন অনুসারে ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৮১৫ কোটি ডলার পাচার হয়।
(সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ও সর্বজন কথা নভেম্বর- ২০২৪ )
ব্যাংক খাতে ভঙ্গুর অবস্থা
শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠন ছিল নিয়মিত ঘটনা। গত দেড় দশকে হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বাংলাদেশে ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ফারমার্স ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো ঘটেছে। যে প্রক্রিয়ায় এই কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে- প্রভাবশালী- ব্যবসায়ী গোষ্ঠি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া; সরাসরি জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ লুন্ঠন; ব্যাংক মালিক হয়ে লুটপাট ব্যাংকের টাকা লুটে ব্যাংক মালিক, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার মদদে সরকার ঘনিষ্ট ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ব্যাংক দখল, ব্যাংক লুটে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠি ও রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা, যেমন অনিয়ম-দুর্নীতির প্রশ্রয় প্রদান, লুন্ঠনের হোতাদের বিচার না করা , খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার না করা, উদারভাবে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা প্রদান, ব্যাংক কোম্পানী আইন সংশোধন করে ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ বৃদ্ধি ইত্যাদি।২০০৯ সালে আওয়াামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী ঘনিষ্ঠ শিল্প গোষ্ঠী বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা গ্রুপসহ লুটেরা ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে একেবারে ভঙ্গুর করে ফেলেছে। ২০০৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬.১৩ শতাংশ। খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া যায়, বাস্তবে তা অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর নিজেই বলেছেন, সবকিছু হিসাব করা হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ২৫-৩০ শতাংশে পৌছে যাবে।এই লুটেরা গোষ্ঠী বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা শোধ না করে ব্যাংক খাতকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলেছে । ( দৈনিক প্রথম আলো সর্বজন কথা নভেম্বর -২০২৪)
শেয়ার বাজার কারসাজি
গত ১৫ বছরে কারসাজি ও জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের শেয়ার বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অন্তত ১ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ২০১১ সালে। সে সময় লোকসানের কারণে বিনিয়োগকারীদের আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। এই ঘটনার পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে শেয়ারবাজার জালিয়াতির পেছনে ৬০ জনকে চিহ্নিত করা হয়, যাদের মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ও শেখ হাসিনার বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মতো সরকার ঘনিষ্ট প্রভাবশালীরা রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে প্রক্রিয়ায় শেয়ার বাজার কারসাজি করা হয় তার মধ্যে রয়েছে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি, প্লেসমেন্ট বানিজ্য, আইপিও প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, অমনিবাস হিসাবের আড়ালে সন্দেহজনক লেনদেন ইত্যাদি। প্রতিবেদনে অপরাধীদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হলেও তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। ফলে, বর্তমানেও শেয়ার বাজারে কারসাজি চলছে।
(সূত্র: সর্বজন কথা, নভেম্বর-২০২৪)
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে লুণ্ঠন
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট সমাধানের নামে হাসিনা সরকার দেশি-বিদেশী বেসরকারী মালিকানা ভিত্তিক ও বিদেশী ঋণ নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান ও আমদানি নির্ভর জ্বালানি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দেয়। বিভিন্ন দেশি- বিদেশী গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে যেন কোনো জবাবদিহি করতে না হয়, সেজন্য রীতিমতো আইন করে আদালতে বিচার চাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত রহিত করা হয়।
বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের কথা বলে বেসরকারি মালিকানায় একেরপর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে সেওলোকে বসিয়ে বসিয়ে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়া হয় এবং দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও নবায়ন যোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ না নিয়ে বিদেশ থেকে ব্যয় বহুল এলএনজি ও কয়লা আমদানির ব্যবস্থা করা হয়।
২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে দেওয়া ক্যাপাসিটি চার্জ বা ভাড়ার পরিমান প্রায় ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। ভারতের আদানির কাছে বিদ্যুতের দাম বকেয়া পড়েছে ৮০ কোটি ডলার, যা বর্তমান অন্তর্বর্তী কালীন সরকার কে পরিশোধ করতে হচ্ছে। জ্বালানি তেল আমদানিকারক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিদেশী সরবরাহকারীরা পাবে প্রায় ২৭ কোটি ডলার। আর বাংলাদেশ গ্যাস উত্তোলনকারী মার্কিন কোম্পানী শেভরন গ্যাসের বাবদ পাবে ২০ কোটি ডলার। তিন বছর ধরে নিয়মিত বকেয়া অর্থ পরিশোধের চাপে আছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত । অর্থ সংকটে থাকায় বিল দিতে পারছে না পিডিবি ও পেট্্েরাবাংলা । পিডিবি ও পেট্্েরাবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এ অবস্থায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে বকেয়া বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা ।
ঘাটতি মেটানোর কথা বলে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। ১৫ বছরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৪ বার। সরকার রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ১১.৩৮ বিলিয়ন, মাতারবাড়ি প্রকল্পের জন্য জাপানের কাছ থেকে ৪.৪ বিলিয়ন, কয়লাভিত্তিক পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১.৯৮ বিলিয়ন এবং রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১.৬ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ নেয়। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও জ্বালানি আমদানি বাবদ বাড়তি খরচ দেশের অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরী করছে।
অভ্যন্তরীন ও বিদেশী ঋণ এবং ঋণ পরিশোধের চাপ
২০২৪ সালের ৭ আগষ্ট দৈনিক বার্তার খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের দাবি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারী শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। ৫ আগস্টে পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই বিশাল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের বোঝার সাগরে দেশকে ফেলে গেছেন। ২০২৪ সালে মাথাপিছু ঋণের বোঝা ১ লাখ টাকার বেশি। অজস্র ঋণ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর কৌশল পুরো জাতিকে বড় ধরনের দীর্ঘ মেয়াদী ঋণের সাগরে নিমজ্জিত করেছে। আর তা অত্যন্ত বিপদজনক হয়েছে এ জন্য যে ওই ঋণের সিংহভাগই স্রেফ পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। নিউইয়র্ক ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি দাবি করেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
ই আর ডি সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী অর্থ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড ৩৩৫ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে, যা আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৬৮ কোটি ডলার বেশি। এর আগে কোনো অর্থ বছরে সরকারকে এত ঋণ পরিশোধ করতে হয়নি। সর্বশেষ ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করেছিল সরকার। চলতি অর্থবছরে এই ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৪৫০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
(৭ আগষ্ট-২০২৪, দৈনিক বার্তা )
শ্রম খাত
বাংলাদেশে বেশির ভাগ শ্রমজীবি মানুষের কর্মসংস্থান হয় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশের শ্রমজীবি মানুষের ৮৪.৯ শতাংশই কাজ করছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, যেখানে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি, কর্মপরিবেশ, ইউনিয়ন করার অধিকারসহ কোনো ধরনের শ্রম অধিকারেরই নিশ্চয়তা থাকে না। এসব খাতের শ্রমিকদের কাজ নাই, মজুরি নাই’ ভিত্তিতে কাজ করতে হয়। এদের কোন নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা, ওভার টাইম, সবেতন, ছুটি, বিমা, পেনশন, গ্র্যাচুইটির অধিকার থাকে না। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ও কারখানা মালিকেরা শ্রমিকদের যে মজুরি দেন, তা মানসম্পন্ন জীবন যাপনের জন্য যথেষ্ট নয়। দেশের অনেক প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কোনো নূন্যতম মজুরি নির্ধারিত হয়নি। যে ৪২টি খাতে নূন্যতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছে, সেটাও জীবন যাত্রার ব্যয়ের তুলনায় খুবই কম। দেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাত গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য ২০২৩ সালে যে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নূন্যতম মজুরি নির্ধারন করা হয়, তা শ্রমিকদের দাবির অর্ধেক এবং পরিবার সহ দারিদ্রসীমার উপরে বসবাসের জন্য যথেষট নয়। দেশের শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও ভয়ংকর অনিরাপদ, যার ফলে নিয়মিত অকাল মৃত্যু ঘটছে। পরিবহন, নির্মাণ, শিল্প, কৃষি, দিনমজুর, ইসপাত, জাহাজ-ভাঙা, পাথর ভাঙা, ইটভাটা, চাতাল, করাত কল, চামড়া ইত্যাদি কোনো খাতেই শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন নেই। কর্মস্থলে সরাসরি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়া ও অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশের কারণে প্রতি বছর ধুকে ধুকে মৃত্যুবরণ করেন বহু শ্রমিক, যার কোন হিসাব কারো কাছে নেই।
(সর্বজন কথা, নভেম্বর- ২০২৪)
কৃষি ব্যবস্থা
বাংলাদেশে দারিদ্র সৃষ্টির প্রধান ক্ষেত্র কৃষি ব্যবস্থা। কৃষিতে জমির মালিকানা ব্যবস্থায় মাঝারি ও ক্ষুদ্র্র কৃষক ভূমি মালিকদের প্রাধান্য ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে এবং জমির মালিকানা অনুপস্থিত ভূ-স্বামীদের কাছে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। কৃষিতে ভূমিহীনতা সমস্যা বাড়তে বাড়তে এখন গ্রামীণ পরিবার গুলোর ৮২ শতাংশই ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। কৃষিকাজে মালিক কৃষকের তুলনায় বর্গাদার কৃষকের অনুপাত ক্রমবর্ধমান। এখন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ভূমি মালিক কৃষকরা অপরের জমি বর্গা বা ইজারা নিয়ে কৃষি কাজে নিয়োজিত থেকে পরিবারের ভরণ পোষণের প্রয়োজন মেটানোর সংগ্রামে নিয়োজিত। কৃষিজাত পণ্যের বাজারজাতকরণে মধ্যসত্ত্ব ভোগীদের অব্যাহত দৌরাত্মের কারণে কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম থেকে চরমভাবে বঞ্চিত। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক পরিবারগুলো এনজিও এবং মহাজনী ঋণের ফাঁদে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
আশির দশক থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতির আগ্রাসনে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা বাজারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এর পরিণামে শিক্ষা আজ বাজারের পণ্যে পরিণত হয়েছে। যেখানে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের জন্য প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত পণ্য হিসাবে শিক্ষা বিক্রয়ের হাজার হাজার মুনাফা লোভী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। দেশের সংবিধানের ১৭(ক) ধারায় রাষ্ট্র নাগরিকদের কাছে অঙ্গীকার করেছে যে, রাষ্ট্র সকল শিশুর জন্য একটি একক মানসম্পন্ন গণমুখী সর্বজনীন অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত চালু করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কিন্তু সংবিধানের এই অঙ্গীকার স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর ও বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষা বাজেট ও দীর্ঘদিন ধরে একই বৃত্তে ঘুরছে। শিক্ষা খাতে বাজেটের বরাদ্দ ১১.৭ শতাংশ এবং জিডিপির ২.১০ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ ইউনেসকো এডুকেশন ফ্রেমওয়ার্কে একটি দেশের জিডিপির ৪-৬ শতাংশ ও মোট বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিশ্বের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
গত এক দশকে স্বাস্থ্য খাতে বাণিজ্যিকীকরণ বেড়েছে, বেসরকারী বানিজ্যিক চিকিৎসা কেন্দ্রের উপর মানুষের নির্ভরতা বেড়েছে, চিকিৎসার জন্য ব্যক্তি খরচের অংশ বেড়েছে। চিকিৎসার প্রয়োজনে মানুষের দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে মানুষ সর্বস্বান্তÍ হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের এক রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশের মানুষকে চিকিৎসা খরচের ৭২ শতাংশ নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হয়। সে খরচ করতে গিয়ে প্রতি বছর ৩.৪ শতাংশ বা ৫২ লাখ ৩৪ হাজার মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে চলে যায়। দেশের আনাচে কানাচে ব্যঙের ছাতার মত বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার গজিয়ে উঠায় পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মুনাফাবাজির অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জরিপ অনুসারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম ব্যয় করে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির বরাদ্দ ২ শতাংশের কম।
আয় বৈষম্য
এটা অস্বীকার করা যাবে না স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশের মানুষের আয় বেড়েছে, দারিদ্রও কমেছে। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বৈষম্য। একদিকে অর্থনেতিক সংকটে তুলনামূলক কম দামে চাল-ডাল-তেল-চিনি কেনার জন্য টিসিবি আর ওএমএস লাইন দীর্ঘ হয়েছে অবশ্য বর্তমান সরকার ৪৩ লাক্ষ টিসিবি কার্ড বাতিল করে সংকট আরও বৃদ্ধি করেছে অন্যদিকে দেশে বিলাসবহুল গাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট বিক্রি বেড়েছে। যখন দেশের সাধারণ মানুষ জীবন যাত্রার ব্যয় কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, তখন দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলস্ এক্স’র প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলস্ রিপোর্ট ২০১৮ মোতাবেক ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশকে পেছনে ফেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। এই প্রতিবেদন
অনুযায়ী বাংলাদেশের ২০১৭ সালে অতি ধনীর সংখ্যা ছিল ২৫৫ জন। যাদের নীট সম্পদের পরিমাণ ৩০ মিলিয়ন বা ২৫২ কোটি টাকার বেশি। দেশের ব্যাংক খাতে গত সেপ্টেম্বর শেষে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা।এর মধ্যে কোটিপতিদের হিসাবে জমা ছিল ৭ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। যা মোট আমানতের ৪১%। ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে যা এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারত সহ ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি। সংস্থাটির হিসাব অনুসারে আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা ১১.৪ শতাংশ হারে বাড়বে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, দেশের আয়ে সবচেয়ে ধনী ও সবচেয়ে গরীব ৫ শতাংশের ভাগ ছিল যথাক্রমে ২৪.৬১ শতাংশ এবং ০.৭৮ শতাংশ। বিবিএসের ২০২২ জরিপ অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ৫ শতাংশ মানুষের হাতে এখন মোট আয়ের ৩০.০৪ শতাংশ পুঞ্জিভূত। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ০.৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ গত একযুগে দেশের মোট আয়ের মাত্র ৫ শতাংশ ধনীর ভাগ যখন উল্লেখযোগ্য পরিমানে বেড়েছে, তখন সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশের ভাগ মোট আয়ের চেয়ে কমে অর্ধেক হয়েছে। এ কারনেই আয় বৈষম্য বিষয়ক গিনি সহগ ২০১০ সালের ০.৪৫৮ থেকে ২০২২ সাল শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৪৯৯, যা উচ্চ আয় বৈষম্যকেই নির্দেশ করে।দেশের সম্পদ যে কতিপয় বিশেষ গোষ্ঠির হাতে পুঞ্জিভূত হয়েছে তা ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য থেকে বোঝা যায়। দেশে ৫০ কোটি ডলার বা ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমানের সম্পদ আছে ২১ ব্যক্তির কাছে।
এদিকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির ১৮ অক্টোবর – ২০২৪ এর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে চরম দারিদ্রসীমায় বাস করছে ৪ কোটি ১৭ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ৬.৫ শতাংশের অবস্থা গুরুতর। এই যে শ্রেণী বৈষম্য এই নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা মাথা ঘামান না। তারা নিজ নিজ শ্রেণীর স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। এখন এত যে বৈষম্য বিরোধীতার কথা বলা হচ্ছে, সেখানেও শ্রেণী বৈষম্যের কথা কেউ বলছেন না । এই না বলাটাও স্বাভাবিক এবং এটাই শ্রেণীর ধর্ম।
বাজারি শোষণ, আর্থিক খাতে লুটপাট, বেকারত্ব, শিক্ষা স্বাস্থ্য এবং সম্পদ ও আয় বৈষম্য, দারিদ্র্য সৃষ্টি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে অভিঘাত সৃষ্টি করেছে তা মুক্তবাজার অর্থনীতি তথা স্বজন তোষি পুঁজিবাদের বিষময় ফল।
অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎস ও পল ক্রুগম্যানের নেতৃত্বে একদল অর্থনীতিবিদ ওই আশির দশক থেকেই প্রমাণ করে চলেছেন যে মুক্তবাজার অর্থনীতি ছদ্মবেশধধারী বাজার মৌলবাদী পুঁজিবাদ ও একটি ভ্রান্ত দর্শন। বাংলাদেশের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত সমাজে বৈষম্য ও বঞ্চনা বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র
পুনঃ সৃষ্টি করে চলেছে। বর্তমানে বাজারি শোষণ থেকে সাধারণ জনগণকে বাঁচাতে হলে সরকারকে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ভেঙে দিয়ে বাজার ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় আইন ২০১২ এর আওতায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করে কাজে লাগাতে হবে। এছাড়াও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আরো যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
১) মজুদদারি প্রতিরোধ
২) গণবন্টন ব্যবস্থা গড়ে তুলে দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য রেশনিং এর ব্যবস্থা করা
৩) শুল্ক কর হ্রাস করেও বিপিসির মুনাফা কমিয়ে পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত জ্বালানি ডিজেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমানো
৪) হাটবাজারে পথে-ঘাটে চাঁদাবাজি বন্ধ করা , পণ্য ক্রয় বিক্রয়ে রশিদ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা
৫) নিত্যপণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ, আমদানি, মজুদ, বিক্রয়ের উপর নিয়মিত তদারকের কাঠামো গড়ে তোলা।
৬) বাজার কারসাজির পিছনে দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলোকে দ্রুত বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করা।
৮০ দশক থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাডোলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বাজারের পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। এই বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করে সর্বজনীন বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনে ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু করতে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। সেই লক্ষ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে শ্রম খাতে তীব্র শোষণ বিদ্যমান। প্রতিষ্ঠানিক ও অপ্রতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা যে মজুরি পাই তা জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট নয় ফলে শ্রমিকরা দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে । শ্রম খাতের এই শোষণ থেকে শ্রমিক শ্রেণীকে বাঁচাতে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশে আয় ও সম্পদ বন্টনের বৈষম্য বাড়তে বাড়তে বিপদজনক স্তরে পৌঁছে গেছে। এই আয় আরও সম্পদ পুনর্বন্টন মূলক করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে প্রগতিশীল আয়কর – সম্পত্তিকরের মাধ্যমে জিডিপির ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সরকারি রাজস্ব হিসেবে সংগ্রহ করে ওই রাজস্ব শিক্ষা স্বাস্থ্য সামাজিক নিরাপত্তা প্রধানত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পেনশন, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন, পরিবেশ উন্নয়ন, নিম্নবিত্ত পরিবারের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা, গণপরিবহন, বেকার ভাতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ব্যয় করতে হবে। বৈষম্য দূর করার জন্য প্রতিরক্ষা বাহিনী, আমলাতন্ত্র ও অভ্যন্তরের নিরাপত্তা বাহিনী গুলোর জন্য সরকারি ব্যয় জিডিপির সামান্য অংশ ব্যয় করতে হবে। সর্বোপরি উৎপাদন কাঠামো তথা বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া আয় ও সম্পদের বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়।
(সর্বজন কথা নভেম্বর-২০২৪, দৈনিক সমকাল )
টীকা
* স্বজনতোষী পুঁজিবাদ
ক্ষমতাসীন দল বা গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের আত্মীয়-স্বজন, দলের নেতাকর্মী ,পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সামরিক অফিসার ও আমলারা পুঁজি লুন্ঠনের সুযোগ কে কাজে লাগিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে যে ধন-সম্পদ আহরণ করে তাই স্বজনতোষী পুঁজিবাদ। বিগত ১৫ বছরে শাসনামলে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা তার পরিবার ,আত্মীয়-স্বজন ,তার আশীর্বাদ পুষ্ট ব্যবসায়ী ও আমলারা সরকারি ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পুজি লুন্ঠনের মাধ্যমে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) লালন করেছিল। ক্রোনি ক্যাপিটালিজম এদেশের আয় বৈষম্য ও অন্যান্য বৈষম্যকে ক্রমেই পর্বত প্রমাণ করে তুলেছে।
* নয়া উদারবাদী অর্থনীতি
(১)রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প , ব্যাংক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবই ব্যক্তি মালিকানায় তুলে দিতে হবে।
(২)ব্যবসা , দাম , মজুরি ও আর্থিক বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকবে না
(৩) সরকার কোন ক্ষেত্রে ভর্তুকি বা মূল্য সমর্থন দেবে না
(৪)আমদানি রপ্তানি ক্ষেত্রে কোন শুল্ক থাকবে না। একেই বলা হয় নয়া উদারবাদী অর্থনীতি । বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদের আগ্রাসী রূপ হচ্ছে নয়া উদারবাদ । বাংলাদেশেও নয়া উদারবাদী অর্থনীতি বিদ্যমান।
* মুক্ত বাজার অর্থনীতি
বাজার অর্থনীতির একটি বিশেষণ যুক্ত রূপের নাম মুক্তবাজার অর্থনীতি । শুধু বাজার অর্থনীতি বললে ও মুক্ত কথাটি এসে যায় । কারণ বাজার শক্তি গুলোকে (চাহিদা ও সরবরাহ ) মুক্ত ভাবেই ক্রীড়া করতে দিতে হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সবকিছু নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না । নব্বই দশকের শুরুতে আওয়ামী লীগ মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা কে তাদের রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে ঘোষণা করে।
অধ্যক্ষ (অবঃ),সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ ,খুলনা