Thursday, April 24, 2025
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়আওয়ামী ফোবিয়ার কারণ কী?

আওয়ামী ফোবিয়ার কারণ কী?

আবু নাসের অনীক

চব্বিশের গণঅভ্যূত্থাণ পরবর্তীতে ফ্যাসিস্ট সরকার আওয়ামী ফোবিয়াতে আক্রান্ত দেশের একটি অংশের মানুষ। ৫ আগস্টের পরপরই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি সামনে আসে।

কিছুদিন পরেই দাবি থিতুও হয়ে আসে; সাম্প্রতিক সময়ে এটি আবার ফোকাস হয়েছে। আওয়ামী লীগ কর্তৃক এতবড় ম্যাসাকার ঘটার পরে; গণঅভ্যূত্থানের মধ্যে দিয়ে শেখ হাসিনা আর অধিকাংশ নেতৃত্ব দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরেও আওয়ামী ফোবিয়ার কারণটা কী?

আপনাদের সবসময় মনে হয় আওয়ামী লীগ ফিরে আসছে! আসবে! একটি ঘোরের মধ্যে থাকেন। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারি না এটা আপনাদের মনে হয় কেন? এটিও বুঝতে পারি না তারা ফিরে আসলে কী হবে?

যারা গত ১৫ বছর ধরে একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা জারি রাখলো; মানুষের জীবনকে দূর্বীসহ করে তুলেছিলো; লুটপাটের প্লাবনে আচ্ছাদিত ছিল। তারা কেমনে ফিরে আসে?

গণহত্যার বিচারের জন্য ইতিমধ্যেই শেখ হাসিনাসহ অন্যান্যদের নামে মামালা দায়ের হয়েছে বিশেষ ট্রাইবুন্যালে। শেখ হাসিনার নামে মামলার সংখ্যা এখন পর্যন্ত ২০৪ টি। হত্যা মামলা তার মধ্যে ১৭৯ টি।

থানায় শেখ হাসিনা এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে তার মধ্যে ৮০ শতাংশ মামলায় মেরিট বিহীন। কারণ এই মামলাগুলি করা হয়েছে গণহারে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘গণহত্যা, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ অনেক ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। যারা এইসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা করতে হবে।

সেটা না করে এই যে ঢালাও হত্যা মামলা হচ্ছে, তাতে মামলার মেরিট নষ্ট হতে পারে এবং মূল অপরাধীরা আড়ালে চলে যেতে পারে।

আসামি এমনভাবে দেয়া হচ্ছে, তাতে কথা উঠছে যে সম্পৃক্ত নয় এমন ব্যক্তিদেরও আসামি করা হচ্ছে’ (১৬ অক্টোবর, ২০২৪ ডিডাব্লিউ)।

শেখ হাসিনার নামে এখনও একটিও মামলার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হয় নাই। অন্য কোন একটি মামলারও চার্জ গঠন হয় নাই। অথচ এর মধ্যে আট মাস পার হয়ে গেছে। এই বিলম্বের প্রধান কারণ এলোমেলো মামলা হওয়া।

প্রাথমিক অবস্থায় কোন সতর্কতা গ্রহণ করা হয় নাই। যদিও নাগরিক সমাজের পক্ষে বারংবার এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। হাল আমলের এনসিপি চুপ থেকেছে; মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙলে তখন চিৎকার করেছে।

 শেখ হাসিনা, তার সরকারের মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের বিচারিক প্রক্রিয়াতে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যাল গঠন করাটাকে প্রথমেই বিতর্কিত করেছে সরকার।

এই আদালতের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। যিনি দীর্ঘ দিন এবি পার্টির যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্বে ছিলেন।

তারও আগে জামায়াতের নেতা। এক সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন।

অথচ এখানে চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিলো একজন ননপার্টিজান আইনজীবীকে। যোগ্যতাসম্পন্ন এমন অনেক নিরেপেক্ষ আইনজীবী ছিলেন।

উনি আওয়ামী সরকারের সময় যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিটি মামলাতেই হেরেছেন। এবং রায়ের পর বলেছেন, ন্যায্য বিচার পান নাই।

তিনি এখন শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়ার সরকারী চিফ প্রসিকিউটর মানেই মামলার রায় নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠাটা অস্বাভাবিক না।

এমনিতেই ‘মৃত্যুদন্ড’ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন আছে। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সম্প্রতি বলেছে, ‘বাংলাদেশ যত দিন মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করবে না, তত দিন দিল্লিকে শেখ হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের আশ্রয় দিতে হবে’ (০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪-প্রথম আলো)।

সরকার শেখ হাসিনাকে ফেরত পাওয়ার জন্য ভারতের কাছে শুধু কূটনৈতিক পত্র দিয়েছে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেয়নি। আল–জাজিরার বিশ্লেষণমূলক অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড স্টোরি’তে কথা বলেন ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত।

তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, ‘বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে ভারত কি প্রত্যর্পণ করবে?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কতটা নিরপেক্ষ, তা-ও ভেবে দেখবে ভারত। পাশাপাশি কিছু টেকনিক্যাল বিষয়ও রয়েছে সেটাও বিবেচনায় নেবে ভারত।

এ ছাড়া বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতটা ন্যায়বিচার পাবেনÍএ ধরনের নানা বিষয়ও আছে’ (০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪-প্রথম আলো)।

আমি উপরে উল্লেখ করেছি বিতর্কিত চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ নিয়ে। এটা গ্লোবাল ইস্যু হিসাবে ভবিষ্যতে সামনে আসবে।

প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও নয়াদিল্লি চাইলে ঢাকার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। চুক্তির মধ্যে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের সুযোগ রয়েছে।

অর্থাত ধরে নেওয়া যায় যে ভারত শেখ হাসিনাসহ অন্য কোন অভিযুক্তকে ফেরত পাঠাবে না।

 দেশে যখন তার নামে শতাধিক খুনের মামলা রয়েছে; তখন কি তিনি নিজের ইচ্ছাতে দেশে ফিরে আসবেন বিচারের মুখোমুখী হওয়ার জন্য?

শাস্তি পাওয়ার জন্য? প্রশ্নই আসে না! অর্থাত তার দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা শূণ্য পর্যায়ে। আপনারা বা সরকার হাজার চেষ্টা করেও তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না কাছাকাছি সময়ে।

এনসিপি’র কাছে প্রশ্ন আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পূর্ণবাসন নিয়ে তারপরেও আপনারা এত প্যানিকড কেন?

আপনাদের কি মনে হয়, আওয়ামী লীগ ফিরে এসে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেলে সরকার গঠন করবে? তারপর আপনাদেরকে ধরে ধরে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে দিবে?

যদি সেইটা করেই ফেলে (আকাশ-কুসুম কল্পনা) তাহলে তো বুঝতে হবে আপনাদের বিরাট রাজনৈতিক পরাজয় ঘটবে। কারণ আপনারা তো দাবি করে থাকেন দেশের সমস্ত মানুষ আপনাদের পক্ষে।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ বা তার নিবন্ধন বাতিল করতে হলে কোর্ট ফেস করতে হবে। নতুবা ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯’ প্রয়োগ করে করতে হবে। এটার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কটা কী হবে সেটা তার আগে ঠিক করতে হবে।

তবে সেটা আদৌও সম্ভব বলে আমি মনে করি না। কারণ এই বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না সরকার বা আপনাদের পক্ষে।

এনসিপি এবং সরকারকে বলছি, প্যানিকড হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে নেই করতে যেয়ে যে এক্টিভিটি আপনারা করছেন তার সবটাই আপনাদের বিপক্ষে যাচ্ছে।

অতি দক্ষিণপন্থীদের ফাঁদে পড়ে আপনারা আওয়ামী লীগকে মুছে ফেলতে যেয়ে ৭১ কে রিপ্লেস করার চেষ্টা করছেন ২৪ দিয়ে। যেটি কোনভাবেই চূড়ান্তভাবে সফল হবে না।

কারণ আওয়ামী লীগ “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” নিয়ে বাণিজ্য করেছে। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধ তো তার একার বিষয় না। যারা তৎকালীন সময়ে ৭১ এর বিরোধিতা করেছে তারা ব্যতীত সবাই এটা ওন করে।

চব্বিশকে নিয়ে এখন আপনারা যেমন বাণিজ্য করছেন; কিন্তু এই ২৪ তো শুধুমাত্র আপনাদের একার না। এটা তো আমাদেরও সবার।

তাহলে আমরা যদি এই বাণিজ্যের বিরোধিতা করি সেটা আপনাদেরকে করবো। “২৪ এর চেতনাকে” না। ৭১ এর ব্যাপারটিও ঠিক তাই।

পরিতাপের বিষয় আপনারা সেটা গুলিয়ে ফেলছেন। শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে যেয়ে মুক্তিযুদ্ধর মুর‌্যাল ভেঙে ফেলছেন।

 শেখ মুজিবুর রহমান এর নাম মুছে দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধীতাকারীর নামে সেটি করছেন। ‘বঙ্গবন্ধু এভিনিউ’ এর পূর্ব নাম ছিলো ‘জিন্নাহ এভিনিউ’।

 সেটি এখন আবরার এর নাম রিপ্লেস করেছেন। সাধারণভাবেও এটি বিবেচনার মধ্যে আসলো না শেখ মুজিবুর রহমান এর নাম আবরারকে দিয়ে রিপ্লেস করা যায় না।

আপনারা স্বীকার করুন আর না করুন, ৭১ পূর্ববর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান এর ভূমিকাকে এভাবে নাম মুছে নেই করে দেওয়া সম্ভব না।

এসব কর্মকান্ডে শুধুমাত্র আপনারা আর যাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এসব করছেন তারা ব্যতীত দেশের কোন মানুষ এই কার্যকলাপকে ভালোভাবে গ্রহন করছে না।

 যেমন আমি করছিনা। অথচ ২৪ এ আপনাদের মতো আমাদেরও ভূমিকা ছিলো; এমন অনেক মানুষ আছেন যারা এই তৎপরতাকে সঠিক মনে করছেন না। দ্বিমত পোষণ করলেই তাকে আবার ‘দোসর’ ট্যাগ দিচ্ছেন।

সরকার এবং এনসিপি আপনাদের উচিত হবে এমনসব কর্মকান্ড থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখা। দেশের আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে ফোকাস করা।

অতি দক্ষিণপন্থী তৎপরতারে সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত না করা এবং এসব ঘটনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ২৪ আর ৭১ কে একই নিক্তিতে মাপতে না যাওয়া। মিত্রকে শত্রুতে পরিণত করা থেকে বিরত থাকুন।

আপনারা যতোই এসব করবেন ততোই নেতিবাচক জনমত গড়ে উঠবে। ‘আওয়ামী দোসর’ বলে মজা পাইতে পারেন; মনে শান্তি আসতে পারে। কিন্তু পলিটিক্যালি মাইনাস হতে থাকবেন।

আওয়ামী ফোবিয়াতে প্যানিকড না হয়ে গণহত্যা আর দুর্নীতির বিচারের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। সে বিষয়ে জনমত গড়ে তুলুন।

তবে এটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, গণহত্যাকারী একটা দলের বিচার করবেন আর একটি দল বহাল তবিয়তে রাজনীতি করবে সেটাও কিন্তু হবে না। সিলেক্টিভ না হয়ে কালেক্টিভ হন।

 দেশে তো সংস্কার হবে। আপনারাই বলেছেন এই সংস্কার করে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার সব পথ বন্ধ করে ফেলবেন। তাহলে তো ফ্যাসিবাদ আর কায়েম হওয়ার সম্ভাবনা থাকবেনা।

তারপরেও আওয়ামী লীগ নিয়ে প্যানিকড কেন? কারণ আপনারা আপনাদের এক্টিভিটির কারণেই প্যানিকড হচ্ছেন।

সংবিধান সংস্কার করেই ফ্যাসিবাদ বা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা ঠেকানো সম্ভব না বলেই আমি মনে করি। বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার উচ্ছেদ ব্যতীত সেটা বাস্তবায়ন যোগ্য না। গণমানুষের রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বেই সেটি হবে।

                                                                                                                  – লেখক

এই বিভাগের আরো সংবাদ

আলোচিত