আবু নাসের অনীক
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জন্ম নিলো আরো একটি রাজনৈতিক দল। অভ্যূত্থান পরবর্তী সময়ে নানা ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে অবশেষে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটলো। যার প্রধান নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন দল গঠনের তিন দিন আগেও সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্বপালনকারী জনাব নাহিদ ইসলাম।
নতুন দলটির নাম জাতীয় নাগরিক কমিটি; যার সদস্য শুধুমাত্র শহুরে নাগরিক। তাদের নাগরিকের আওতায় কৃষক বা শ্রমিক নাই! দলটি সম্পর্কে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে আলোচনা হচ্ছে।
অধিকাংশই দলটিকে কিংস পার্টি হিসাবে অভিহিত করছেন। যারা দলটির নাগরিক সমর্থনের জায়গাতে আছেন বা এর নেতৃত্বে তারা প্রতিউত্তরে বলছেন, কিংস পার্টি (বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে ইঙ্গিত করে) বাংলাদেশে নতুন না।
এই বক্তব্যের সাথে আমিও একমত। তবে বিগত সময়ের কিংস পার্টির সাথে এখনকার এই কিংস পার্টির বেশ কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য আছে। সবচেয়ে যেটা বড় পার্থক্য সেটি হলো, তৎকালীন সময়ের কিংসরা সরাসরি নেতৃত্বে দিয়ে পার্টি গঠন প্রক্রিয়াতে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের এখনকার কিংস আড়ালে থেকে অন্যদেরকে দিয়ে খেলাধুলা করাচ্ছেন।
জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের একটি পডকাস্টে অংশ নিয়ে প্রফেসর ড: ইউনূস (এখনকার কিং) বলেন, ‘ছাত্ররা ভালো কাজ করছে। এখন তারা বলছে, কেন আপনি আপনার–আমাদের নিজস্ব দল গঠন করেন না, আমরা একটা সুযোগ নেব। তারা বলেছে, আপনার কোনো সুযোগ নেই, এমনকি সংসদে আপনার একটিও আসন থাকবে না। কেন? কারণ, কেউ আপনাকে চেনে না। আমি তাদের বললাম, পুরো জাতি তাদেরকে চেনে। তারা যা করতে চায়, সে বিষয়ে তাদেরকে একটা সুযোগ দিই। সুতরাং, তারা এটা করবে।’ (৩০ জানুয়ারি ২০২৫ আরটিভি অনলাইন) এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে এটি পরিস্কার এনসিপি প্রকৃতপক্ষে তাঁর পার্টি। তিনি বিগত দিনের কিংসদের মতো সামনে আসছেন না।
এনসিপি’র নেতৃত্বরা বলছেন, এটি ছাত্রদের আর তরুণদের দল! এটি একটি হাস্যকর কথা! আজকে যারা দলটির নেতৃত্বে আছেন বা যারা এই দলটির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন তারা কি সারাজীবন তরুণ থাকবেন? তাদের কি বয়স কখনও বাড়বেনা? তখন তারা কি করবেন? এই দলটি থেকে নিজেদেরকে বিযুক্ত করে ফেলবেন? করবেন না তো!
মূলত বিশেষ কিছু সুবিধা নেওয়ার জন্যই তারা এই প্রচারণা চালাচ্ছেন। তাদের ভিন্ন আর একটি প্রচারণা; তারাই বাংলাদেশে প্রথম ছাত্র-তরুণদেরকে নিয়ে দল গঠন করেছেন। এটাও একটা বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথম তারুণ্য নির্ভর দল গঠন করে জাসদ। যার তৎকালীন প্রধান নেতৃবৃন্দের এবং দলে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশের বয়স এখনকার এনসিপি নেতৃত্বের চাইতেও কম ছিলো। কিন্তু তখন তারা এই প্রচারণা হাজির করে নাই যে এটি ছাত্র-তরুণদের দল।
এনসিপি’র দায়িত্ব গ্রহণের তিন দিন পূর্বে পদত্যাগী উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের এই পদত্যাগকে অনেকেই গ্লোরিফাই করেছেন। এবং তিনি ক্ষমতা থেকে সরে এসে জনতার কাতারে দাঁড়িয়েছেন বলে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এবং এটা না কি বাংলাদেশে প্রথম একটা উদাহরণ হলো!
সরি টু সে, আমি এজন্য সাবেক উপদেষ্টাকে যেমন অভিনন্দন জানাতে পারছিনা একইসাথে এটাকে কোন উদাহরণ হিসাবেও গ্রহণ করছিনা। কারণ নাহিদ তার উপদেষ্টা পদ ছাড়তে বেসিক্যালি বাধ্য হয়েছেন।
কেন বাধ্য হলেন? কারণ তারা বহু পূর্ব থেকেই পরিকল্পনার মধ্যে ছিলেন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার। দলটি গঠনের কার্যক্রম যখন তারা ম্যাচিউরড করে আনেন তখন তারা একটি বড় ধরণের সমস্যাতে আটকে যান।
সমস্যাটি হলো প্রধান নেতৃত্ব হিসাবে একজন গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব এই দলটি পাচ্ছিলো না। সেক্ষেত্রে সর্বশেষ দেখা গেলো নাহিদই এটা কাভার করতে পারেন। এর অন্য কোন বিকল্প তাদের সামনে ছিলো না।
এখন তিনি তো উপদেষ্টা থেকে সাংবিধানিকভাবে একটি দলের প্রধান নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারেন না। এজন্যই তিনি পদত্যাগ করে দলের দায়িত্ব নিতে এই মুহুর্তে বাধ্য হয়েছেন।
এখন এই যে তিনি উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করে আসলেন তাতে কি তিনি বর্তমান পাওয়ার ষ্ট্রাকচারের বাইরে চলে গেলেন? একটুও না। বরং তিনি এখন আরো বেশিমাত্রায় স্টেট পাওয়ার এক্সাসাইজ এর সুযোগ পাবেন।
কিভাবে পাবেন? তিনি এখন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতা; যে দলটি বর্তমান সরকারের সবচেয়ে কাছের এবং সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী দল। বরং বলা যায় এই সরকার তাদেরই নমিনেটেড।
প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রথম ভাষণেই বলেন, ‘আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে’ (২৫ আগস্ট ২০২৪- প্রথম আলো)। এই ছাত্ররা কারা? নিশ্চয় নতুন করে এটা বলার কিছু নাই!
নাহিদের সতীর্থ দুজন মাহফুজ এবং আসিফ রয়েছেন উপদেষ্টামন্ডলীতে। শুধু তাই নয় তারা দুজন এমন দুইটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন যে দুটি মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
যা তারা ইতিমধ্যেই করছেন। এর পুরো সুফলটা ভোগ করবে এনসিপি।
দেশের রাজনৈতিক সিনারিওতে প্রভাব বিস্তারের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনমতকে পুরোটাই প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। কারণ সকলধরনের গণমাধ্যম থাকে এই মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। যাদেরকে ব্যবহার করে জনসম্মতি উৎপাদন করা হয়।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে ব্যবহার করে সাংগাঠনিক বিস্তৃতিতে সরাসরি প্রভাব রাখা যায়। কারণ এই মন্ত্রণালয় স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে। যার উপকারভোগীরা হয়ে থাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রধানের সংগঠণের সাথে সম্পৃক্ত।
অন্তত এই অন্তবর্তী সরকারের আমলে নাহিদ পদত্যাগ করে এসে যে আরো বেশি ক্ষমতায়ীত হয়েছেন এটা নিশ্চয় পরিস্কার হয়েছে এখন।
এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানটি যে পুরোটাই সরকারী সহযোগীতায় ঘটেছে এটা তো এখন আর নতুন করে বলার কিছু নাই। তাদের নেতৃত্ব বক্তব্যে বলেছেন, জেলা থেকে লোক আনতে তারা পয়সা খরচ করেন নাই।
শতভাগ সত্য বলেছেন তো! পয়সা আপনারা কেন খরচ করবেন! খরচ করছে তো জেলা প্রশাসন। একটি নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্টেজসহ সমাবেশস্থলের সবকিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইহাকেই বলে সরকারি ব্যবস্থাপনা!
সমাবেশে আপনারা বল্লেন,দেশে আর বিভাজনের রাজনীতি হতে দেবেন না। কিন্তু সবার বক্তব্যই ছিলো বিভাজনমূলক। সারজিস আর হাসনাতের বক্তব্যে মনে হলো এখনই যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়বেন!!
হাসনাত বল্লেন, ‘দেশ থেকে পরিবারতন্ত্র কবরস্থ হয়েছে, তা নিশ্চিত করতে চাই।’ মানে ইতিমধ্যেই কবরস্থ হয়ে গেছে! তো বিএনপিকে কি কবরস্থ করে ফেলেছেন? তারেক রহমান কি কবরস্থ হয়ে গেছেন?
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র উচ্ছেদ করতে হবে। আমি এটার সাথে শতভাগ একমত। কিন্তু আপনি বা আপনারা যেভাবে মুখের কথাতেই উচ্ছেদ করে ফেলছেন এতে আদৌ পরিবারতন্ত্র উচ্ছেদ না হয়ে আরো বেশি শক্তিশালী হবে।
আমাদের সমাজ শ্রেণী বিভক্ত। শ্রেণীগত জায়গা থেকে আপনারও সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্রেণীরই অন্তর্ভূক্ত। যার কারণে আচার-আচরণের জায়গা থেকে অন্যদের চাইতে আপনাদের কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা।
আপনারা কথায় কথায় ফেনা তুলেন, ছাত্র- তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। কিন্তু বাস্তবতাটা কি? দেশের ছাত্র তরুণদের একটি উল্লেযোগ্য অংশ বিএনপি, আওয়ামী লীগ, বামপন্থীদলগুলোসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও যুক্ত।
আপনারা ইতিমধ্যেই নিজেদেরকে শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক দল হিসাবে ভাবতে শুরু করেছেন। যা লুটেরা চরিত্রেরই বহিপ্রকাশ! আমি জাস্ট একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করবো লেখাটি।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তরুণেরা সত্যিই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের খারাপ কোনো কিছুর সঙ্গে সংস্পর্শ নেই বা নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছানোর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা নেই। তারা এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল গঠন করছে বা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এটা দরকার।’
অন্যদিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে বৈছাআ রংপুর মহানগরের মুখপাত্র চাঁদা দাবী করে ফোনে বলছে, ‘আপনি তো দেখছেন বিষয়টি কোথায় গেছে, ইউএনও-ডিসিকে সামলাতে হচ্ছে। যদি মনে হয় কিছু কমাবেন, তাহলে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন। আমি চাই না আপনাদের কোনো সমস্যা হোক। জানেন তো, সংগঠন চালাতে হলে কী কী করতে হয়।’ (০২ মার্চ ২০২৫- প্রথম আলো)
বৈছাআ একাংশের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ’। সেটি আত্ম প্রকাশের দিন কমিটি গঠন নিয়ে হাতাহাতি মারামারি হয়। একাধিক ছাত্রী পর্যন্ত আহত হয়ে হসপিটালাইজড হন।
কমিটি গঠন নিয়ে কেনো হাঙ্গামা হয়? যখন কমিটির মধ্যে মধু থাকে; পাওয়ার এক্সাসাইজ করার বা প্রটোকলের সুবিধা থাকে তখনই এমনটি ঘটে। সেটা অতীতে আমরা দেখেছি। লাখ টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগের পদ বাণিজ্য আর এরকম হানাহানি মারামারি।
জনগণের মুক্তি এদের হাত ধরে সম্ভব না। গণমানুষের রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বেই সেটা হতে পারে। কোন শহুরে মধ্যবিত্তর প্রতিনিধিত্বকারী; সরকারের প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় গঠিত রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে না।