Wednesday, February 5, 2025
Homeআঞ্চলিকবহু অপকর্ম করেও এখনো ধরা ছোয়ার বাইরে বাগেরহাট সদরের খাদ্য গুদামের ওসিএলএসডি

বহু অপকর্ম করেও এখনো ধরা ছোয়ার বাইরে বাগেরহাট সদরের খাদ্য গুদামের ওসিএলএসডি

বিশেষ প্রতিনিধি

ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর বাগেরহাট জেলা সদরের সরকারি খাদ্য গুদামের ওসিএলএসডি আবু বকর সিদ্দিক বহু অপকর্ম করেও এখনো ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছেন। দুনীর্তি, অনিয়ম ও একাধিক নারী নারীকেলেংকারীর হোতা এই আবু বকর সিদ্দিক ৫ আগষ্টের পর রাতারাতি ভোল্ট পাল্টে এখন হয়েছেন বৈষম্য বিরোধী খাদ্য পরিদর্শক সমিতির নেতা। ফলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে গুঞ্জন সৃষ্টি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো অভিযোগ করেন, বাগেরহাট জেলা সদর খাদ্য গুদামের ওসিএলএসডি আবু বকর সিদ্দিকের বাড়ি ঝিনেদা জেলার হরিকুন্ডু উপজেলা এলাকায়। ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকায় তার ভাগ্য খুলে যায়। ছাত্রলীগের কোঠায় ২০১০ সালের উপ-খাদ্য পরিদর্শক হিসেবে আবু বকর সিদ্দিক চাকরিতে যোগদান করেন। তখন ওই নিয়োগ ছিল বিতর্কিত। ওই নিয়োগে প্রকৃত মেধাবীদের বাদ দেয়া হয়েছে। যারা চাকরি পেয়েছে তাদের মধ্যে যারা ১৯ নাম্বার পান তারা অধিদপ্তর থেকে ৯১ করে চুড়ান্ত চাকরির জন্য মনোনীত করা হয়েছে। এই নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে দুনীর্তি দমন কমিশন থেকে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে ওই নিয়োগ হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আবু বকর সিদ্দিক চাকরিতে যোগদানের পর পরই খাদ্য বিভাগের সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গা গুদামে পোষ্টিং নিয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেন। বিপুল অংকের টাকা ঘুষের বিনিময়ে তিনি ২০১৪ সালে পুনরায় খাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগ পান বলে অভিযোগ রয়েছে।

সুত্র বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এমন কোন অপকর্ম নেই যা আবু বকর সিদ্দিক করেন নাই। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। গুরুপাপে লঘু দণ্ড দেয়া হয়েছে। খাদ্য গুদামের সবচেয়ে বড় অপরাধ গুদামের চাল পাল্টানো। সে অপরাধ আবু বকর সিদ্দিক প্রতিটি গুদামেই হরহামেশে করেছেন। তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে। তদন্তে সত্যতা মিলছে কিন্তু পুনরায় আবার তাকে গুদামে পোষ্টিং দেয়া হয়েছে। ৫ আগষ্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পরিবর্তনের পর আবু বকর সিদ্দিক রাতারাতি খোলস পাল্টে ফেলেন। তিনি বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের রোষানলের শিকার ছিলেন বলে বলে দাবী করেন। এমনকি তার সমমনা কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে বৈষম্য বিরোধী খাদ্য পরিদর্শক সমিতি নামে একটি নতুন সংগঠনের ঘোষণা দেন। মৌখিকভাবে ঘোষিত ওই সমিতির নামে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সাথে দেনদরবার করে বর্তমানে খুলনা বিভাগের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলীর বিষয়টি অলিখিতভাবে আবু বকর সিদ্দিক সহ কয়েকজন সুবিধাবাদী কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তারা দাবী করছেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যারা বৈষম্যের শিকার ছিল তাদের সুবিধাজনক জায়গা পোষ্টিং দিতে হবে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে পোষ্টিং প্রত্যাশীদের কাছ থেকে। ফলে স্বৈরাচার সরকারের আমলে প্রকৃত সুবিধা বঞ্চিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।

সুত্র বলছে, বিগত আওয়ামী লীগের দোসর হিসাবে পরিচিত আবু বকর সিদ্দিক চুয়াডাঙ্গার সদর ও আলমডাঙ্গা, সাতক্ষীরার কলারোয়া ও আলাইপুর, ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ড এবং বর্তমানে বাগেরহাট সদর খাদ্য গুদামে ওসি এলএসডি পদে চাকরি করছেন। বাগেরহাট সদর খাদ্য গুদামের পোষ্টিং নিতে তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের জামাতা তৎকালীন মাগুরা জেলা প্রশাসক আবু নাসের বেগকে ৩০ লক্ষ টাকার টাকা প্রদান করেন বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।

সুত্র বলছে, আবু বকর সিদ্দিক যেসব গুদামে চাকরি করছেন প্রতিটি গুদামেই ছিলেন দুনীর্তি ও অনিয়মের শীর্ষে। চুয়াডাঙ্গা সদর গুদামে চাকরীকালীন তিনি তার ছেলের টিউশন ম্যাডামের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এলাকাবাসী হাতেনাতে ধরে পঞ্চাশ লাখ টাকা কাবিন-নামায় ওই ম্যাডামের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। পরে ২২ লাখ টাকা দিয়ে ওই স্ত্রীকে ডিভোর্স দেন। ওই সময় গুদামের চাল পাল্টানো ও নিম্নমানের লালচে চাল ক্রয় করায় অধিদপ্তর থেকে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় আবু বকর সিদ্দিককে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কিছু দিনের মধ্যে আবু বকর সিদ্দিক স্ব-মহিমায় ফিরে আসেন।

 সাতক্ষীরার কলারোয়ায় চাকরীকালীন তিনি পার্শ্ববর্তী রায়টা গ্রামের এক নারীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ওই নারীকে বশে আনেন। বিয়ে না করলে ওই নারী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিলের সিন্ধান্ত নেন। ওই ঘটনায় প্রায় চল্লিশ লাখ টাকার বিনিময়ে মিটমাট করেন। ওই সময়ও তিনি খাওয়ার অনুপযোগী নিম্নমানের লালচে বিবর্ণ চাল কিনে কলারোয়া খাদ্য গুদাম ভর্তি করে ফেলেন। যা বিভিন্ন খাতে বিলি /বিতরণ করলে শোরগোল পড়ে যায়। এ সমস্ত অসামাজিক কুকর্ম ও অপকর্মের ঘটনা তৎকালীন পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল। খাদ্য অধিদপ্তর থেকে যার তদন্ত করে সত্যতা পায়। ওই ঘটনায় আবু বকর সিদ্দিককে কলারোয়া থেকে বদলী করে দেয়া হয়।

সুত্র বলছে, বিগত সরকারের আমলে ভিপি মনিরুল হাসানের নেতৃত্বাধীন খাদ্য পরিদর্শক সমিতির প্যানেলের প্রচার সম্পদক ছিলেন আবু বকর সিদ্দিক। ওই কমিটির নেতৃত্বে খুলনা অঞ্চলের খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলীসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ওই কমিটিতে থেকে আবু বকর সিদ্দিক নানা অনিয়ম করেও থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সুত্র বলছে, বিগত বোরো সংগ্রহ মৌসুমে বাগেরহাট খাদ্য গুদামের ওসিএলএসডি আবু বকর সিদ্দিক ধান-চাল ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট উপজেলার কৃষকের স্বাক্ষর জাল করে বাইরের জেলা থেকে ধান ক্রয় করেছেন। প্রতিটি বিলের বিপরীতে স্বাক্ষর করে বাগেরহাট কৃষি ব্যাংক থেকে নিজেই টাকা উত্তোলন করে নিয়েছেন। ওই ধান বিক্রির সাথে কৃষকের কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না। বর্তমানে বাগেরহাট সদর খাদ্য গুদামে মজুদকৃত সংগৃহীত চালের খামাল গুলিতে (প্রত্যেকটা খামালের ভিতরে) ৪/৫ গাড়ি করে পুরাতন নিম্নমানের লালচে চালের মজুদ আছে। যা স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।

সুত্র বলছে, প্রতি সংগ্রহ মৌসুমের পূর্বেই খাদ্য বিভাগ বিভিন্ন জুট (সরকারি /বেসরকারি) মিলের মাধ্যমে নতুন খালি বস্তা ক্রয় করে। সে মোতাবেক বাগেরহাট সদর এলএসডি তে সরাসরি মিল থেকে নতুন খালি বস্তার বরাদ্দ দেওয়া হয়। ধুরন্ধর ওসি এল এসডি আবু বকর সিদ্দিক নতুন বস্তার স্থলে পুরাতন অকেজো খালি বস্তা গ্রহণ করেন। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। এই বস্তার কেলেঙ্কারি জানাজানি হলে খাদ্য বিভাগ থেকে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ব্যাপকভাবে লেখালেখি হয়। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলে ওসি এলএসডি ম্যানেজ ফর্মুলায় উক্ত ঘটনা ধামাচাপা দেন।

সুত্র বলছে, আবু বকর সিদ্দিক দুনীর্তি ও অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। ঢাকায় কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে বাড়ি ক্রয় করেছেন। খুলনা ময়লাপোতার পাশে কিনেছেন ৯৮ লাখ টাকা দামের বিলাস বহুল ফ্ল্যাট। ওই ফ্ল্যাটে আরেক স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। আবু বকর সিদ্দিক নিজস্ব গাড়িতে চলাচল করেন। তার রেন্ট এ কারের ব্যবসা আছে। চুয়াডাঙ্গা শহরে পাঁচ কাঠাজমি সহ রেডিমেড বাড়ি ক্রয় করেছেন। এছাড়া তার নামে-বেনামে রয়েছে লাখ লাখ টাকার সম্পদ। প্রশ্ন উঠেছে, ধুরন্ধর এই খাদ্য কর্মকর্তার বিপুল পরিমাণ এই টাকার উৎস কী? দুনীর্তি দমন কমিশন থেকে তদন্ত করলে তার অবৈধ আয়ের উৎস বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। অভিযোগের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাগেরহাট সদর খাদ্য গুদামের ওসিএলএসডি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, এসব অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। চাকরি জীবনে তিনি কোন অনিয়ম করেননি। নারীকেলেংকারী বিষয়টিও বানোয়াট। বদলী তদবীরের সাথে তার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। খুলনার ময়লাপোতা ও চুয়াডাঙ্গায় তার কোন বাড়ি নেই বলে দাবী করেন আবু বকর সিদ্দিক। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাগেরহাট সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জাকির হোসেন বলেন, অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। বাগেরহাট

জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) শাকিল আহমেদও বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন।

এই বিভাগের আরো সংবাদ

আলোচিত