কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?

0
144

কাজী ফিরোজ

বাংলাদেশর অর্থনীতি – রাজনীতি, শিক্ষা – সংস্কৃতি, শিল্প-কৃশি, নির্বাচন, আইন বিচার, হত্যা – নাশকতা, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ষণ, নির্যাতন এবং ঘটনা – দূর্ঘটনা সর্বোপরি নিত্য পণ্যের ক্রমাগত মূল্য বৃদ্ধির পাগলাঘোড়া নিয়ন্ত্রণহীন ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দৃশ্যমান এইসব ঘটনার বয়ান আম জনতার হতাশা বাড়িয়ে দিতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের চলমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া মানুষের মাঝে নানামুখী উদবেগ উৎকণ্ঠা ও সংঘাত সংকটের সৃষ্টি করেছে এবং খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবন ধারাকে নানাভাবে বিপন্ন বিপর্যস্ত বিক্ষুব্ধ ও বিষাদময় করে তুলেছে।

এরইমাঝে দূর্গা পূজার সময় মন্দিরে মুসলমান সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ রাখার অভিযোগে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক হামলা হলো ফেনি, কুমিল্লা এবং রংপুরের মাঝি পড়া সহ দেশের প্রায় ৭০টি স্থানে হামলা হলেও বিচার হয়নি একটারও। প্রায় এক দশক পূর্বে রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার বিচার আজও হয়নি।কুমিল্লার সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিচার করে নি।আজ পর্যন্ত কোন সাম্প্রদায়িক হামলা বা অপরাধের বিচার হয়নি। সাম্প্রদায়িক অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে ইতিহাসের এই ঘৃণ্য অপরাধ হ্রাস পেতো। তাই হাল আমলের সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী উঠেছে। দাবী উঠেছে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। কিন্তু সরকার সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সংকীর্ণ দলীয় সার্থের রাজনীতি শুরু করেছেন।

এর ফলে শাসক শ্রেণির প্রতি সাধারণ মানুষর অবিশ্বাস ও অনাস্থা পুঞ্জীভূত হচ্ছে। বাড়ছে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও বৈরী মনোভাব। শাসক শ্রেণি তার নিজের ব্যর্থতা এবং সমস্ত সমস্যার দ্বায়ভার করোনাকালীন দূর্যোগের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদেরকে দায়মুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অহরহ। নিজেদের পাহাড় প্রমান ব্যর্থতা ঢাকতে প্রতিদিন একটি বিশেষ দলকে আক্রমন করে চলেছেন বিরামহীন ভাবে।

অন্য দিকে বিশ্ব ব্যাপী করোনা অতিমারির মধ্যে আম জনতাকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দিচ্ছেন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সাফল্য গাথা। স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন – পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলি নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল বা মহাকাশে ছুটে বেড়ানো স্যাটেলাইট কিম্বা মেট্রো রেলের কাব্য কথা অথবা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির গর্বিত তথ্য – উপাত্ত কিংবা করোনা সনাক্তের নিম্ন হার ও করোনা প্রতিরোধক টীকা প্রদানের সুখকর পরিসংখ্যান।

কদিন আগেও মানুষ যখন করোনা আতংকে আতঙ্কিত তখন জনৈক মন্ত্রী আম জনতাকে আস্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে – ” আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী। ”

এই অভয়বাণী উচ্চারিত হবার সাথে সাথে কিছু ‘বেঅক্কল’ আদম সন্তান মুখে মাস্ক পরা প্রায় ছেড়ে দিলেন। তখন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় দায়িত্ব পালন রত রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যগণ মাস্ক পরিয়ে ছাড়লেন।

যারা প্রকৃত শক্তিশালী তারা করোনা কালীন দূর্যোগে আম জনতাকে জিম্মি করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলেন। শাহেদ, শারমিন, সাবরিনা এবং তাদের কথিত দোসর ও রক্ষাকর্তাগণ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে আরও বেশী ধনি হলেন।প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনার অর্থে ঋণখেলাপী হাজার কোটি টাকার মালিক আরও কোটি কোটি টাকা পেয়ে পূর্বের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হলেন। দেশের কৃষক শ্রমিক, মেহনতী মানুষের প্রনোদনার টাকা চলে গেল দলীয় সমর্থক ও তাদের স্বজনের হাতে। তারাও কমবেশি শক্তিশালী হলেন।

বৈশিক অতিমারির মত মহা দূর্যোগে আমরা দেখলাম চিকিৎসা ব্যবস্থার চরম বেহাল দশা। দেখলাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আর স্বাস্থ মন্ত্রনালয়ের বহুবিধ অনিয়ম, দূর্নীতি, দেউলিয়াপনা শুনলাম দরজা জানালার পর্দা এবং রংপুর মেডিকেল কলেজের চেয়ার ক্রয় করা হয় যথাক্রমে ত্রিশ লাখ টাকা। চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি কয়েকগুণ বেশি মূল্য দিয়ে ক্রয় করে ঢাকাতে ফেলে রাখা হয়েছে।

দেখলাম- ফাইল চুরির অভিযোগে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় প্রথম আলোর সাহসী সাংবাদিক রোজিনাকে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছেছিল। এখন শুনছি ঐ মন্ত্রনালয়ের ডজন খানেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল চুরি হয়েছে। কে চুরি করলো ? কি ছিল ঐ ফাইলে? কেন চুরি হলো ? চোর কি রক্ষা কর্তার চেয়েও শক্তিশালী? – এসব প্রশ্নের উত্তর এখন অবধি অজানা।

যাইহোক করোনার দাপট কমতেই শুরু হয়েছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গুর প্রকোপে থরহরি কম্প। এবার ঢাকার দুই মেয়র অনেক আগে থেকেই মশক নিধন অভিযানে নেমে কথার ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন। পরে যখন মশক সেনারা অনবরত বংশ বৃদ্ধি করতঃ ডেঙ্গু বিস্তার বাড়িয়ে ডেংগু রোগীতে হাসপাতাল, কিনিক ভরিয়ে তুলতে লাগলো তখন সুর পাল্টে মেয়র সাহেবরা বলতে লাগলেন, “আমরা বাড়ির ভিতরকার বাথরুম, নালা বা ছাদ বাগানের এডিস মশা কি ভাবে মারবো? ওটা মারা বাড়ীর মালিক বা বাসিন্দাদের দায়িত্ব”। গবেষকরা বললেন, বেশী দামে ‘ভেজাল’ ওষুধ ক্রয় করে তা ছিটানোতে এডিস মশা মরেনি বরং শক্তিশালী হয়েছে। যার ফলে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে, বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। যেমন বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু। বিশেষ করে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ময়লা টানা গাড়ির আনাড়ি চালক কেড়ে নিল মেধাবী ছাত্র ও প্রাক্তন সাংবাদিকের তরতাজা দুটি অমূল্য জীবন। কে নেবে এর দায়?

এই পটভূমিতে অক্টোবরের শুরুতে হঠাৎ করে বিপিসি কোন পূর্বাভাস না দিয় জ্বালানি তেল ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিলেন। এ এক নজীর বিহীন ঘটনা। সমস্ত মহল থেকে সমালোচনা, বাদ- প্রতিবাদ, বিক্ষোভ শুরু হলে বিপিসি ও সরকার বললেন, আমাদের দেশে ডিজেলের দাম কম হলে ভারতে পাচার হতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বেড়েছে। এবং করোনা কালীন সময়ের লোকসান কাটাতে এই মূল্য বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম কমে তখন তো জ্বালানি তেলের দাম কমে না। আর সীমান্তে যার দায়িত্ব পালন করেন তারা কি পাচার রোধ করতে পারেন না? তাহলে কি ধরে নিতে হবে ‘ সরকার তেল পাচার আটকাতে ব্যর্থ ?’

অর্থনীতিবিদগণ বললেন, করোনা কালীন সময়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ৪৭ হাজার কোটি টাকারও বেশী মুনাফা অর্জন করেছে।

যাইহোক, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় ঢাকায় ব্যাপক পরিবহন ধর্মঘট শুরু হলে নাকাল হলো নাগরিক জীবন।

এক পর্যায়ে সরকার গণপরিবহন মালিকদের সাথে আলোচনা করে ২৭% বাস ভাড়া বাড়িয়ে দিলেন। বাস্তবে বাস মালিক শ্রমিকরা প্রায় ৫০% বেশি ভাড়া আদায় করতে থাকেন।শুরু হয় গণ- পরিবহন শ্রমিক দের সাথে যাত্রীদের বচসা, হাতাহাতি, গ্যাঞ্জাম ফ্যাসাদ সহ এক নৈরাজ্যিক পরিস্থিতির। মজার বিষয় গণপরিবহনের মত সি এন জি চালিত যানবাহন ও ট্রাক, লরি, কাভাড ভ্যান, এবং বিভিন্ন মালামাল পরিবহন- কারী যানবাহনে ভাড়া বৃদ্ধি করা হোল। ভাড়া বাড়লো লঞ্চ, ইস্টিমারে।

এর ফলে বাজারে নিত্য পণ্যের মূল্যও বৃদ্ধি হলো লাগামহীন ভাবে।

সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লো। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং বর্ধিত বাসভাড়া প্রত্যাহারের দাবীতে ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্কসবাদী)ও বাম গণতান্ত্রি জোট আন্দোলনে নেমেছেন।

ছাত্রদের ৫০% বাসভাড়ার আন্দোলন ক্রমাগত জোরদার ও নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাওয়ার ফলে সরকার তড়িঘড়ি করে বিআরটিসিতে অর্ধেক ভাড়া চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হোল – দেশে পর্যাপ্ত বিআরটিসি’র বাস নাই। যা আছে তা দিয়ে ঢাকা শহর ম্যানেজ করা যায় না। ফলে বেসরকারি পরিবহনে ভাড়া কমিয়ে ছাত্র আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। সরকারও বেসরকারী গণপরিবহনে অর্ধভাড়া চালু করতে পারবে না। এই সব কাজের মধ্যদিয়ে সরকার বুঝিয়ে দিলেন যে, তারা মূলতঃ বাস ও যানবাহন মালিকদের পক্ষে। ঋণ খেলাপী, অর্থ আত্মসাত ও অর্থ পাচারকারী, সরকারী সুবিধা ও জনগনের অধিকার ভোগকারী লুটেরা ধনিক বনিকের সাথেই গাঁটছড়া বেঁধেছেন। সদা সর্বদা পুঁজিবাদের সেবায় নিয়োজিত আছেন।

অপর দিকে পোড়খাওয়া জনগণও দেখছে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো গণমানুষের জীবন জীবীকার সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা আরও দেখছে মেগা প্রকল্পের ব্যাপক সাফল্যের কেচ্ছা কাহিনি শুনে পেট ভরছে না। তাই আজ প্রয়োজন, পুঁজিবাদী সমাজ ও শোষণ ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে, শোষণ বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা এবং তার জন্য প্রয়োজন বামপন্থার নীতি, আদর্শ ও সংগ্রামের লাল পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরা। আরও দরকার শোষিতের কণ্ঠ একত্রিত করে গগনবিদারী আওয়াজ তোলা।

জয় মেহনতী মানুষের জয়, জয় মার্ক্সবাদ, লেলিন বাদের জয়।
দুনিয়ার মজদুর এক হও।

সবশেষে আবারও বলি, সময়ের ডাক আসছে। সমাজতন্ত্রের আহবান ধ্বনিত হচ্ছে দিকে দিকে। কালের যাত্রার ধ্বনি যদি শুনে থাকো কমরেড, তবে আসো এক নতুন সমাজ গড়ে তুলি।

সদস্য কেন্দ্রীয় কমিটি

বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টি, (মার্কসবাদী)