ড. তাসদিকুর রহমান (সনেট)
‘তুলা বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক আঁশ’ প্রতিপাদ্যটি নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো সারাবিশ্বে ‘বিশ্ব তুলা দিবস-২০২০’ পালিত হচ্ছে আজ বুধবার। প্রথম দিবসটি ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় পালিত হয়েছিল। মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত না হলেও বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করছে। বাংলাদেশে এবার প্রথম বারের মত তুলা উন্নয়ন বোর্ড দিবসটি উদযাপন করতে যাচ্ছে। দিবসটিতে তুলা উন্নয়ন বোর্ড ওয়েবিনার, কর্মশালা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্প পরিসরে রাজধানীসহ দেশের তুলা উৎপাদন এলাকায় মানব উদ্দীপন পালন, বিভিন্ন ধরনের পোস্টার ও ফেস্টুন প্রদর্শনীর মাধ্যমে দিবসটি উৎযাপন করবে। দিবসটি বাংলাদেশে তুলাচাষ সম্প্রসারণ এবং দেশের উৎপাদিত তুলা দিয়ে গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। তুলা একটি আন্তর্জাতিক মানের শিল্প ফসল যা বিশ্ব ব্যাপি ‘সাদা সোনা’ হিসাবে পরিচিত। তুলার সাথে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য, ইতিহাস, সভ্যতা, অর্থনীতি এবং এটি আমাদের দ্বিতীয় মৌলিক চাহিদা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের তুলার তৈরি সকল বস্ত্রের প্রয়োজনীয় রয়েছে। খাদ্য ছাড়া আমরা কিছুদিন বাঁচতে পারলেও তুলা এবং তুলার তৈরি বস্ত্র ছাড়া আমরা একদিনও চলতে পারব না।
বিশ্বে প্রায় ৭৫টি দেশে তুলা চাষ করা হয়। বিশ্বে তুলা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ৪০তম অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বে চার ধরনের তুলার আবাদ হয়। এড়ংংুঢ়রঁস যরৎংঁঃঁস, এড়ংংুঢ়রঁস নবৎনধফবহংব, এড়ংংুঢ়রঁস অৎনড়ৎবঁস এবং এড়ংংুঢ়রঁস যবৎনধপবঁস। আমাদের দেশে এড়ংংুঢ়রঁস যরৎংঁঃঁস এবং এড়ংংুঢ়রঁস অৎনড়ৎবঁস এর চাষ করা হয়। তুলা উৎপাদনে প্রতিনিধিত্বকারী দেশ সমূহের মধ্যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান এবং ব্রাজিল অন্যতম। সমগ্র বিশ্বের প্রায় ২৬ শতাংশ তুলা ভারত এবং ২২ শতাংশ তুলা চীনে উৎপাদিত হয়।
প্রতি টন বীজতুলা বছরব্যাপি প্রতি দিন গড়ে ৫ (পাঁচ) জন লোকের কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়তা করে। বিশ্বের ২ দশমিক ১ শতাংশ চাষযোগ্য জমিতে তুলার আবাদ হয় এবং সেই তুলা টেক্সটাইল সেক্টরে ২৭ শতাংশ অবদান রাখে। বাংলাদেশে তিনটি শস্য মৌসুমের মধ্যে খরিপ-২ তে মাত্র ০ দশমিক ৫২ শতাংশ জমিতে তুলা চাষ করা হয়। তুলা থেকে আঁশ ছাড়াও ভোজ্য তেল, খৈল, জ্বালানি উপজাত হিসাবে পাওয়া যায়। ভোজ্য তেলে খুব কম পরিমানে কোলেস্টরেল থাকে এবং তুলার বীজ থেকে ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ হারে তেল পাওয়া যায় যা উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ এবং সয়াবিন তেলের চেয়েও পুষ্টিকর। খৈলে রয়েছে উচ্চ প্রোটিন ২৪ শতাংশ, উচ্চ ফ্যাট ২০ শতাংশ হারে এবং ৪০ শতাংশ ক্রুড আঁশ যা পশু ও মৎস্য খাদ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
তুলার ইতিহাস পৃথিবীতে ৭ হাজার বছরের পুরাতন। আর্যদের যুগ থেকে বৃটিশ আমলের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘরে ঘরে কার্পাসের চাষ হতো, চরকায় সুতা তৈরি হতো, তাঁতিরা কাপড় বুনে দেশের চাহিদা মেটাতো। বিশ্ববিখ্যাত মসলিন কাপড় ও অন্যান্য সুতি বস্ত্র সমগ্র ইউরোপে রপ্তানি হতো বিনিময়ে এসেছে বহু মূল্যবান ধাতু। সে সময় বাংলাদেশের নিতান্ত দীন-হীন নারী-পুরুষের গায়েও দেখা যেত সোনা রুপোর আংটি, অলংকার, মন্দিরে মন্দিরে দেব-দেবীর স্বর্ণমূর্তি। ম্যানচেস্টারের কাপড় বাংলাদেশী কাপড়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারত না বলে ইংল্যান্ডে বাংলাদেশী কাপড় নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।
সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের উপনিবেশিক নীতির ফলে শুধু যে কার্পাস চাষ আর তাঁত শিল্পই ধ্বংস হল তা নয়। এদেশের কৃষককে বাধ্য করা হলো তৎকালীন বিশ্বের কারখানা, ইংল্যান্ডের কলকারখানার জন্য কাঁচামাল প্রস্তত করতে। এর উদাহরণ স্বরূপ নীল চাষের উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের তাঁতশিল্পকে ধ্বংশ করে, তাঁতীদের বাড়ি বাড়ি সিপাহী বসিয়ে তাঁত চালানো বন্ধ রাখতো। এ নিয়ে দুই বার তাঁতী বিদ্রোহ হয়েছিল, কিন্ত ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের তুলা চাষ স্থানান্তর হয় ইংরেজদের নির্ভরযোগ্য উপনিবেশ আমেরিকায় আর আমেরিকার নীল চাষ আনা হয় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায়। (খনার বচন, কৃষি ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি – ড. আলি নওয়াজ)।
বাংলাদেশ তুলা আমদানিকারক দেশ হিসাবে বিশ্বের দ্বিতীয়। যেসব দেশ থেকে তুলা আমদানি করা হয় তা হলো আফ্রিকা থেকে ৩৭ শতাংশ, ভারত থেকে ২৬ শতাংশ, সি.আই. এস. দেশ সমুহ থেকে ১১ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১ শতাংশ, অষ্ট্রোলিয়া থেকে ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশ থেকে ১০ শতাংশ।
বিশ্ব তুলা দিবসের গুরত্ব হলো তুলার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একটি প্লাটফর্মে আনা, তুলার সাথে সম্পৃক্ত তুলা উৎপাদনকারী, জিনার, মিলার, গার্মেন্টস মালিক পক্ষ, গবেষক, মিডিয়া কর্মী, কনজুমারের মধ্যে সমন্বয় ঘটানো এবং তুলাকে স্বীকৃতি প্রদান ও দিবসটি আন্তর্জাতিক ভাবে পালনে জাতিসংঘকে অনুরোধ করা। বাংলাদেশে এই দিবসটি উৎযাপনের মধ্য দিয়ে তুলা চাষের সম্প্রসারণ, গবেষণা জোরদারকরণ, তুলার সাথে সম্পৃক্ত সকল অংশীজনের সাথে সমন্বয়, দেশীয় তুলার সর্বোচ্চ ব্যবহার সর্বোপরি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
বৃটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্থান নামক দুটি দেশের সৃষ্টি, পশ্চিম পাকিস্থান ও পূর্ব পাকিস্থান। স্বাধীনতা পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে কোন তুলা উৎপাদন হতো না। সমস্থ তুলা পশ্চিম পাকিস্থান থেকে আমদানি করা হতো। স্বাধীনতা লাভের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। পাট চাষের জন্য পশ্চিম পাকিস্থানে নেওয়া ৩২৫ জন চাষীকে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং ঠাকুরগাঁও এর রাণীশংকৈল এ ৭৯৬ একর জমি তাদের মধ্যে তুলা চাষের জন্য বরাদ্দ প্রদান করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তুলা চাষের শুভ সূচনা ঘটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট জাতির পিতা হত্যার মধ্যে বাংলাদেশে তুলা চাষ কার্যক্রম অনেকটা স্থিমিত হয়ে যায়।
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কোন নিজস্ব ভবন ছিল না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তুলা উন্নয়ন বোর্ডের জন্য একটি নিজস্ব ভবনের জায়গা ও অর্থ বরাদ্দ করেন। গত ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০২০ বর্তমান কৃষি মন্ত্রী তুলা ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। গত ২০১০ সাল থেকে তুলা চাষের দিকে বর্তমান সরকার গুরুত্ব দেওয়ার কারণে তুলার আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে বাংলাদেশে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৮৭ বেল তুলা উৎপাদিত হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশে চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ তুলা উৎপাদনের কর্মকৌশল হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে চাষ উপযোগী জমি নির্ধারণ করা হয়েছে ২ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর এবং তুলার উন্নত জাত ও হাইব্রিড জাত তৈরির জন্য নেওয়া হয়েছে গবেষণা প্রকল্প যা ইতোমধ্যে একনেকের অনুমোদন পেয়েছে। তাছাড়া বিটি কটনের ট্রায়াল সম্পন্ন পূর্বক এ বছরে অনুমোদন পেতে যাচ্ছে চাষাবাদের জন্য।
তুলাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক তন্তুর গবেষণা, সংরক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও তুলা চাষ সম্প্রসারণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু করেছে তুলা উন্নয়ন বোর্ড। সকল কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশেই ২০ লাখ বেল তুলা উৎপাদন ২০৪১ সালের মধ্যেই সম্ভব হবে।
তুলা বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ অবদান রেখে আসছে। বর্তমান বাৎসরিক জিডিপির ১১ দমমিক ১৬ শতাংশ আসে এই বস্ত্রখাত থেকে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে এই সেক্টরে আয় করেছিল ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার। বর্তমান বছরে কোভিড-১৯ কারণে অর্জন কিছুটা কম হলেও বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব তুলা দিবস-২০২০ উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তুলার সাথে সম্পর্কিত সকল কার্যক্রম আরও বেগবান হবে এবং অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে এই হোক আজকের দিনের অঙ্গিকার।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক, কেআইবি, ঢাকা মেট্রোপলিটন
এবং উপ-পরিচালক (স. দ.), তুলা উন্নয়ন বোর্ড, খামারবাড়ি