সত্যপাঠ ডেস্ক
দেশের বেশির ভাগ ইলিশের জোগান আসে বরিশাল বিভাগের নদ-নদী ও সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর থেকে। এবার ভরা মৌসুমেও এ অঞ্চলে ইলিশের আনাগোনা কম। তবে স্থানীয় জেলে ও মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাধা পেয়ে ইলিশ গতিপথ পাল্টেছে। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিনসংলগ্ন সাগরে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। তবে চলতি আগস্টের শেষ দিকে ইলিশের খরা কাটবে বলে আশাবাদী মৎস্য বিশেষজ্ঞরা।
নদ-নদীতে ইলিশ কম আসার কারণ সম্পর্কে জেলেরা বলছেন, নদীতে ইলিশের প্রবেশপথে ও সাগর মোহনায় অসাধু জেলেরা বেহুন্দি, চরগড়া, খুঁটাজাল, ভাসা জালের মতো ছোট ফাঁসের অবৈধ জাল পেতে ঘিরে রাখছেন। এসব জাল অনেকটা বেড়ার মতো। এসব জালে বাধা পেয়ে ইলিশ আবার সাগরে ফিরে যায়। অবৈধ এ জাল যেখানে পাতা হয়, সেখানে কিছুদিনের মধ্যেই চর পড়ে যায়। ডুবোচর, সাগর থেকে নদীতে প্রবেশের মুখে বাধা, অবৈধ জাল আর উত্তরের ঢলে পলি-বর্জ্য থাকায় ইলিশ এবার গতিপথ পরিবর্তন করেছে বলে মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা।
চাঁদপুরে অবস্থিত মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এবার অমাবস্যা হয়ে গেছে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে। অমাবস্যায় দক্ষিণ উপকূলে ইলিশ না মিললেও কক্সবাজার, টেকনাফ এলাকার সাগরে প্রচুর মাছ ধরা পড়েছে। তিথি অনুযায়ী আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে হবে পূর্ণিমা। সে সময় এ অঞ্চলেও ইলিশের দেখা মিলবে বলে আশাবাদী তিনি।
৮ আগস্ট সকালে ‘এফবি সাইফ-২’ নামের একটি ট্রলার নিয়ে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার জেলেরা গভীর সাগরে যান। দুই দফা জাল ফেলে কোনো মাছ না পেয়ে হতাশ জেলেরা ট্রলার নিয়ে পাথরঘাটা থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিনসংলগ্ন গভীর বঙ্গোপসাগরে যান। সেখান থেকে ১০২ মণ ইলিশ নিয়ে জেলেরা গত শুক্রবার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ফেরেন। ২৭ লাখ টাকার বেশি ইলিশ বিক্রি করেন তাঁরা। ট্রলারটির মাঝি জামাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের ট্রলারে আধুনিক সরঞ্জামের পাশাপাশি ইলিশ শিকারে লম্বা জাল ব্যবহার করা হয়েছে। এ জালের প্রস্থ ৯০ হাত।’
বরিশালের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এই সময়ে ইলিশ মাছে বাজার সয়লাব থাকার কথা। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। আর এ জন্য দামও নাগালের বাইরে।
গত শনিবার সকালে বরিশালের পোর্ট রোডের ইলিশ মোকামে গিয়ে দেখা যায়, পাইকার, জেলে ও শ্রমিকদের প্রাণচাঞ্চল্য নেই। এই সময়ে দুই থেকে আড়াই হাজার মণ ইলিশ আসার কথা থাকলেও গতকাল এখানে এসেছে মাত্র ৩৫০ থেকে ৪০০ মণ।
পোর্ট রোড মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি আশরাফ আলী বলেন, ভরা মৌসুমে ইলিশের ঘাটতি ব্যবসায়ীদের হতাশ করেছে। গতকাল এ আড়তে সাগরের ইলিশ মণপ্রতি ২৩ হাজার, ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ৩৮ হাজার, এক কেজির ওপরে ওজনের মণপ্রতি ৪৪ হাজার এবং দেড় কেজির বেশি ওজনের ইলিশ মণপ্রতি পাইকারি ৫৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমদানি কম থাকায় প্রতি মণ ইলিশের দাম চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেশি পাইকারি বাজারে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য বন্দর পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে এ মৌসুমে যেখানে তিন-চার হাজার মণ ইলিশ আসার কথা, সেখানে গতকাল মাত্র ৫০ থেকে ৬০ মণ ইলিশ এসেছে। দামও ছিল চড়া।
টানা ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে গত ২৩ জুলাই। ইলিশের আশায় ট্রলারগুলোর তখনই সাগরে ভাসার কথা। কিন্তু নিম্নচাপের প্রভাবে সমুদ্র উত্তাল ছিল প্রায় আট দিন। পরে মাছ ধরতে গিয়েও মেলেনি কাঙ্ক্ষিত ইলিশ।
বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার পর এ অঞ্চলের অন্তত দুই হাজার ট্রলার মালিক ও সংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার জেলে সাগরে নেমেছিলেন। কিন্তু সাগরে মাছ পাওয়া যায়নি। জেলে ও ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন পূর্ণিমার অপেক্ষায় আছি।’
মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ইলিশের আধিক্য দেখা যায়। ইলিশের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পানির স্ফীতি ও স্রোত বাড়লে এ মাছ আন্দোলিত হয়। এ সময় তারা দল বেঁধে উপকূলের মিঠাপানিতে ফিরে আসে।
আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকোফিশ প্রকল্প-২ এর দলনেতা মাৎস্যবিজ্ঞানী আবদুল ওহাব বলেন, ‘ইলিশ গতিপথ পরিবর্তন করলেও এটা সাময়িক। এই সাময়িক পথ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। যেমন বৃষ্টিপাতের তারতম্য, নদীতে ফেরার পথে বাধা, চর-ডুবোচরে নাব্যতাসংকট, দূষণের মতো সমস্যাগুলো প্রকট হচ্ছে। সাময়িক গতিপথ বাঁক নেওয়ার বিষয়গুলো আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’ তবে এ মাসের শেষ দিকে দক্ষিণ উপকূলে ইলিশের প্রাচুর্য বাড়বে বলে তিনিও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সূত্র : প্রথম আলো