খসরু পারভেজ
১.
রাস্তার মধ্িযখানে শুয়ে আছে নির্বিকার একটি কুকুর
গাড়ি ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে এদিক ওদিক
পাশ কেটে কুকুরের মাথার, ছায়ার
প্রাণহীন কুকুরের হৃদপিন্ড কুঁকড়ে গেছে
খামচে ধরে রাজপথ কোঠাবাড়ি নাগরিক বিশাল শহর
বড়লোক গাড়ির নীচে চাপা পড়ে মানুষ আর
মানুষের সরল জীবন — এটাই নিয়ম, অথচ
কি তাজ্জব ! সমস্ত বিত্তশালী গাড়ি ঘোড়া
সতর্ক স্টিয়ারিংয়ে পাশ কাটছে
শুয়ে থাকা কুকুরের লাশ
যেন, এই লাশটাকে বাঁচাতেই হবে
পৃথিবীর রাজপথে চিৎপাত শুয়ে থাকা
এ রকোম কুকুরের লাশ যেন বাংলাদেশ
আসলে তো, বাংলাদেশ মানেই হলো
জীবনের মুখোমুখি বুলেটের অসভ্য চিৎকার
শোকচিহ্ন কালোব্যাজ পৃথিবীর শহীদ মিনার।
(কুকুর /রোদ ঝলসানো মুখ – সমুদ্র গুপ্ত )
যুদ্ধবিধ্বস্ত, দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশকে এভাবেই কবির চোখে দেখেছিলাম সেই প্রথম যৌবনে। আমার চেতনায় প্রথম সূর্য কবি সমুদ্র গুপ্ত আর তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘রোদ ঝলসানো মুখ’।
২.
আমার কবিতা লেখা শুরু স্কুল জীবনে। পরীক্ষার খাতায় কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তরও কবিতায় লিখে শিক্ষকদের চমকে দিয়েছি। সে সব কি কবিতা ছিল ! ছিল এক ধরনের উন্মাদনা ! ছন্দহীন অন্ত্যমিলে অনর্গল ছাইভস্ম লিখে যাওয়া। তখন ভাবতাম, ধানের সাথে গান মিলালেই কবিতা হয়। এমন সব অনাসৃষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠি। আধুনিক কবিতা কাকে বলে জানি না। লেখার শুরুতে কোনো অভিভাবক ছিল না। আজও নেই। যদিও জানি, সাহিত্েয অভিভাবক বা গুরু লাগে না। সাহিত্েযর গুরু বই।
আধুনিক মনস্ক লেখালেখির শুরুতে আমাকে গভীরভাবে তাড়িত করেছিল দুজন কবির দুটি কবিতার বই। একটি সমুদ্র গুপ্তের ‘রোদ ঝলসানো মুখ’ , অন্যটি নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’। তখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য পর্যন্ত পড়াশুনা। তার আগে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কাজী ইমদাদুল হক, ঈষৎ মাইকেল মধুসূদন দত্ত পাঠ। ঈষৎ এ জন্য যে তখন মাইকেলকে অনুধাবন করার মত যোগ্যতা তৈরি হয়নি। এখনও হয়েছে কি ! তখন ত্রিশের পঞ্চপা-বদের নাম শুনেছি। তাঁদের কবিতা পড়া হয়নি। জীবনানন্দ দাশ দুর্জ্ঞেয় !
ত্রিশের আধুনিক কবিতা পাঠ না করে নির্মলেন্দু গুণের কবিতা বা সমুদ্র গুপ্তের কবিতা পাঠ করে কবিতা লিখতে আসা ! অনেকেই বলবেন এটা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার গল্প। আমার বেলায় এমনটি ঘটেছিল। ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ এর আগে পড়েছিলাম ‘রোদ ঝলসানো মুখ’।
৩.
১৯৮১ সাল। সবে মাত্র ভর্তি হয়েছি কলেজে। কলেজে ছাত্র রাজনীতিতে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাথে জড়িয়ে পড়ি। কলেজে এসে সান্নিধ্য লাভ করি বড় ভাই আব্দুস সাত্তার বাঙ্গালীর। তার আগে আমার কৈশোরের আইডল বিপ্লবী গাজী মহিউদ্দীন বাবলুর কাছ থেকে ছোটদের অর্থনীতিসহ সব লালবই পড়ে ফেলেছি। তাঁর কাছ থেকে সবক নিয়েছি সমাজতান্ত্রিক চেতনার। সামন্ত, দালাল, মুৎসুদ্দী, পুঁজিবাদ, বুর্জোয়া, শ্রেণী সংগ্রাম এ সব সম্পর্কে শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। জাতীয় কৃষক সমিতির সম্মেলন হবে পাবনার বেড়া থানায়। নেতা এ্যাডভোকেট আবুবকর সিদ্দিকী, এ্যাডভোকেট গাজী আব্দুল লতিফ কলেজে এসে আমাদেরকে সম্মেলনে যাবার জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন। চাঁদা দিতে হবে।কিনতে হবে কুপন। শর্ত মেনে রাজি হয়ে গেলাম।আমার ছায়াসঙ্গী গাজী মহিউদ্দীন বাবলু ভাই তো রয়েছেনই। নির্দিষ্ট তারিখে আমরা যশোর থেকে ট্রেনে ঈশ্বরদী। তখন ঈশ্বরদী থেকে পাবনা পর্যন্ত ট্রেন ছিল কিনা আজ মনে নেই। বাসে চড়ে পাবনা, সেখান থেকে বেড়া থানায় পৌঁছে যাই। রাতের শেষে প্রায় ত্রিশজন আমরা সম্মেলন স্থলে পৌঁছাই। সম্মেলনের মহা আয়োজন। উদ্বোধন করবেন বিপ্লবী নেতা হাজী দানেশ। উপস্থিত হয়েছেন মাস্টার ইমাম আলী, অমল সেন, তরুণ নেতা ফজলে হোসেন বাদশাসহ বড়ো বড়ো নেতারা। দুদিন ব্যাপী সম্মেলনে আমাদের থাকার ব্যবস্থা বিশাল প্যা-েলের নীচে ধানের খড় বিছানো মাটির বিছানায় । খাবার ব্যবস্থা গণখিচুড়ি। আমাদের নেতারা সবাই আবাসিক হোটেলে উঠেছেন আমাদের দেয়া চাঁদার টাকায়। মহিউদ্দিীন বাবলু ভাইয়ের সাথে আমি সেই খড় বিছানো মাটির বিছানায় মশার কামড় খেয়ে রাত জেগে থাকি। খানিকটা অসুস্থ হয়েও পড়ি। ঘুম, খাওয়া, গোসল, পয়ঃব্যবস্থার সংকট, আমাদের নেতাদের মুখে সততা ও সাম্েযর বুলি শুনি আর তাদের ব্যক্তিস্বার্থের কথা ভেবে পীড়িত হই।
সম্মেলন কেন্দ্রের একটি স্টলে সমাজতন্ত্র বিষয়ক বিভিন্ন বই নিয়ে একটি স্টল। সেই স্টলে পেয়ে যাই সমুদ্র গুপ্তের ‘রোদ ঝলসানো মুখ’। স্টল থেকে কিনে নিই, সঙ্গে মহসিন শাস্ত্রপাণি সম্পাদিত পত্রিকা ‘ উন্মেষ ‘। বই আর পত্রিকা মিলে দশ টাকার বেশি নয়।
ওখানেই ‘রোদ ঝলসানো মুখ’ পড়তে শুরু করি। আমার কাছে সে এক অপার বিস্ময়। সম্মেলনে মাস্টার ইমান আলীর রক্ত টগবগ করে দেয়া বক্তব্েযর রেশ, আর রক্ত গরম করা সমুদ্র গুপ্তের কবিতা আমার চেতনায় একাকার হয়ে যায়। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা, শিহরণ।
শোষকের লাল চোখ, শোষিতের যন্ত্রণা-ক্ষোভ, ঘাম ও বঞ্চনায় ভেজা কৃষকের মুখ, শ্রমিক শ্রেণীর লড়াই-মিছিল জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে সমুদ্র গুপ্তের কবিতায়। কাব্েযর একটি কবিতার একটি পংক্তি —
“বাংলার আনাচে কানাচে গোলআলুর বদলে বুলেটের চাষ হোক।”
এটি পড়ে আমি চমকে উঠি। আমার চোখের সামনে দুলে ওঠে অত্যাচারী আর দালাল নিধনের অনিবার্য রাইফেল। গভীর রাতে গড়ভাঙায় সাত্তার বাঙালি, সৈয়দ আজগরের সঙ্গে গাজী হামিদের বিপ্লবী বৈঠক শেষে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাঙ্গালীপুরে ফেরা।
পরে বাড়ি ফিরে এই কবিতার বই আমার নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। যত পড়ি তত বিস্মিত হই।
কবি যখন বলেন, :
“সূর্যটাকে ছিঁড়ে এনে কাচের বাসনের মতো আছড়ে দিলে
প্রচ- আলোর ঝটকায় খুলে যাবে পৃথিবীর বন্ধ দরজা
পুড়ে যাবে কালো রঙ
ভেঙে যাবে খাঁচা
ছিঁড়ে যাবে শৃংখলিত পৃথিবীর ভয়াল শিকল “…
অথবা
“প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়ের বিপরীতে সামাজিক ঘূর্ণিঝড় চাই
চাই সেই বেগবান বায়ু
যে বাতাসে পত্রবৎ উড়ে যাবে ঘৃণ্য মানুষ তার শিকড় সমেত।”
তখন আশার আলোয় চকচক করে ওঠে আমার দুচোখ। যৌবনের দিনগুলোতে সমুদ্র গুপ্তের কবিতা হয়ে ওঠে বিশ্বাস আর বিপ্লবের মন্ত্র।
তাঁর কবিতায় – ক্ষুধার্ত ঠোঁটের মতো চাঁদ, সাম্রাজ্েযর মতো কালো রাত, রাত্রিশেষে মোরগের মতো জেগে ওঠা জীবন, যুদ্ধ মানে অনিবার্য ধ্বংস মানে নতুনের উত্থান এই সব পংক্তি, চিত্রকল্প, শব্দবন্ধ আমাকে উজ্জীবিত করে।
বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সমুদ্র গুপ্তের সব কবিতা আমার আরাধ্য হয়ে ওঠে। পরে ‘উন্মেষ’ পত্রিকায় পড়েছি তাঁর অনেক কবিতা। পড়েছি ‘স্বপ্নমঙ্গল কাব্য’ সহ অন্যান্য কাব্য। কিন্তু কবির রাজনৈতিক চেতনাকে পুরোপুরি ধরে রাখতে না পারলেও সেই ‘রোদ ঝলসানো মুখ’ আজও গেঁথে আছে আমার বুকের ভেতর।
‘রোদ ঝলসানো মুখ’ কাব্েযর আর একটি ছোট্ট কবিতা ‘বিভ্রম’ পড়ে আরও বিস্মিত হই। আমাদের মেকী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্তর্সত্য তুলে ধরা এক দুর্লভ অণুকবিতা !
“চমৎকার তিল ভেবে
হাত দিয়ে ছুঁতে যেতেই
তোমার লাল গাল থেকে
উড়ে গেল মাছি ”
কবিতাটি কতবার – কতদিন উচ্চারণ করেছি, বন্ধুদের শুনিয়েছি তার হিসাব দেয়া কঠিন।
আর কবির সেই বিখ্যাত ‘আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধ’ কবিতা ! যা চেতনায় আজও নাড়া দিয়ে যায়। তিনি বলেন, :
“আমার স্বপ্নের সেই সোনালী বৃদ্ধকে আমি
অভিবাদন জানাবো
যিনি আমাকে তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে
দিন দিন শিক্ষিত করে তোলেন, যিনি
তাঁর কোঁচকানো চামড়ার ভাঁজ
একটি একটি খোলেন, আর
আমাকে দেখান
মানুষের কব্জির যাবতীয় কাজ ও কারুকাজ
তিনি দেখান আর বলেন, কোমল স্বরে
শ্রেণীযুদ্ধের ইতিহাসই মানুষের ইতিহাস
আমার চোখের সামনে একেকটি প্রাচীন গুহামুখ
খুলে যায় নিঃশব্দে…”
এই স্বপ্নের সোনালী বৃদ্ধ তাঁর রাজনৈতিক চেতনার দীক্ষাপুরুষ ; সেটা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। একটি কবিতায় কাল মার্কসের জন্মদিনে তিনি বলেছেন : ‘যাঁর নির্ভুল নির্দেশে রাত্রিশেষে মোরগের মতো জেগে ওঠে আমার জীবন।’ তখন বুঝতে পারি মহান কার্ল মার্কস তাঁর জীবনে পরম পুরুষ। মার্কসবাদী চেতনাকে তিনি আজীবন ধারণ করেছেন, লালন করেছেন।
৪.
সমুদ্র গুপ্তের প্রকৃত নাম আব্দুল মান্নান। নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়ে নাম পরিবর্তন করেছেন বলে অনেকে মনে করেন। কিন্ত সেটা সঠিক নয়। ষাটের দশকে তিনি যখন ঢাকা শহরে এসে লেখালেখি শুরু করেন, তখন আব্দুল মান্নান সৈয়দ খ্যাতির মধ্যগগনে। দুজনের নাম বিভ্রান্তি এড়াতে এই সমুদ্র গুপ্ত নাম ধারণ করেন। ১৯৪৬ সালের ২৩ জুন সিরাজগঞ্জে তাঁর জন্ম আর ২০০৮ সালের ১৯ জুলাই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ভারতের ব্যাঙ্গালোরে মৃত্যু। সারাজীবন অভাব-অনটনকে সঙ্গে নিয়ে চলেছেন। কিন্তু অন্যায় – অসত্েযর কাছে কখনও মাথা নত করেন নি। দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য অস্ত্র হাতে লড়েছেন, তেমনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানবমুক্তির কথা বলে গেছেন।
‘রোদ ঝলসানো মুখ’ এর শেষ কবিতায় তিনি বলেছেন :
“আমি মানুষের কাছাকাছি বসি
ঘামের গন্ধের সাথে উষ্ণতাও পাবো
হিংসা ও ঘৃণার সাথে ভালোবাসা পাবো।”
মানুষের কাছাকাছি আসা ভালোবাসা প্রত্যাশী অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযোদ্ধা, স্বতন্ত্রধারার এই কবিকে যথাযথ মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা।
৫.
অনেকবার দেখা হয়েছে। ঢাকায় কবির বাসায় গিয়েছি লেখা আনতে, মধুসূদন জয়ন্তীতে আমন্ত্রণ জানাতে। আমার লেখালেখির খবর রাখতেন। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় আমার কাব্যগ্রন্থ ‘ভালোবাসা এসো ভূগোলময়’। তিনি সেটা জানতেন। বুঝলাম, সে বছরের আগস্টে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি যশোর এলে অথবা কলকাতা থেকে ফেরার পথে , সাগরদাঁড়ীতে এসে আমাকে খবর পাঠালেন, আমি মধুপল্লীতেই ছিলাম। দেখা হলে চিৎকার করে বললেন – ”খসরু এসো ভালোবাসাময় ” তারপর ‘খসরুময় সাগরদাঁড়ী”। আমি বললাম, “না সমুদ্র দা ! ( কেউ তাঁকে ভাই বলে ডেকেছেন শুনি নি ) যশোর – সাগরদাঁড়ী মধুময়, মধুসূদনময়।” তিনি উচ্চস্বরে হেসে জড়িয়ে ধরে বললেন- “এসো ভূগোলময় !”
দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে কিন্তু কোনোদিন সমুদ্র দাকে বলা হয়নি, যে তাঁর ‘রোদ ঝলসানো মুখ’ আমার চেতনায় প্রথম সূর্য ! কেন বলিনি ! বলা হয়নি ! তা আজ আর বলতে পারি না ! তবে একটা অপরাধবোধ আমাকে ব্যথিত করে।
১৯ জুলাই সমুদ্র গুপ্তর জন্মদিন। মাটির কাছাকাছি মানবপ্রেমী এই কবির মৃত্যুদিনে অকুন্ঠ শ্রদ্ধা।