আবু নাসের অনীক
সংক্রমণ শুরুর পর বর্তমানে যে সময়টি যাচ্ছে এ পর্যন্ত সবচেয়ে সংকটপূর্ণ। সংক্রমণের যে গতি-প্রকৃতি আশঙ্কা, আগামীতে আরো বেশি খারাপ হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, বর্তমানে করোনা সংক্রমণে চিকিৎসার জন্য যারা হাসপাতালে আসছে তার ৫০% গ্রামের মানুষ। এইতো কিছুদিন আগেও আমরা অনেককেই বলতে শুনেছি, গ্রামে/বস্তিতে করোনা সংক্রমণ হয় না। ধীরে ধীরে সংক্রমণ ক্রমশই শহর ছাড়িয়ে গ্রামেই ভর করছে বেশি!
শহর এলাকায় সংক্রমণ যতোটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, গ্রামে সেটি অনেক বেশি কঠিন। রাজধানী বা জেলা শহরে চিকিৎসার যেটুকু সুযোগ রয়েছে, উপজেলা-ইউনিয়নে তার কিছুই নেই! গ্রামের মানুষের সচেতনাতার স্তর নিম্নমুখী, তারা টেস্ট করা থেকে বিরত থাকছে এবং করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করছে। গত এক বছর থেকে জনস্বাস্থ্যবিদগণ বলেছেন, উপজেলা-ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতি মনযোগ দিতে। ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত টেস্ট করা যায় তার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। সরকার এ বিষয়ে কর্ণপাত করেনি। পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
গত ২৪ ঘন্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৯ হাজার ৯৬৪, মৃত্যু ১৬৪ জন (রেকর্ড)। শনাক্তের হার ২৯.৩০%। গত ১০ দিনে মৃত্যু বেড়েছে ৭৪%, মোট মৃত্যু বেড়েছে ৭২%, রোগী বেড়েছে ৬৮% (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)। আজকে যেটা রেকর্ড হয়েছে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সেই রেকর্ড ব্রেক হবে বলে ধারণা করা যায়! শনাক্ত যত বৃদ্ধি পাবে, সাথে সাথে মৃত্যুও বাড়বে। চলতি লকডাউন যদি যথাযথভাবে কার্যকর থাকে তবে এর ফলাফল পাওয়া যাবে এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। এবং সেই সুযোগে ঈদকে সামনে রেখে আবার হুড়মুড় করে মানুষ বাড়ি যাবে, তার ২/৩ সপ্তাহ পর সংক্রমণ পরিস্থিতি আবারো নাজুক হবে!!
এমন পরিস্থিতিতে সরকার যখন প্রকৃত তথ্য তুলে ধরবে, তখন সে আরো বেশি করে লুকোচুরি খেলছে। তথ্য গোপন করতে করতে এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে, এখন কোন কিছুই আর তাকে বিব্রত করে না। প্রতিদিন প্রেস রিলিজের মাধ্যমে করোনা প্রস্তুতি বিষয়ক যে তথ্য প্রকাশ করছে, তার সাথে বাস্তবের আকাশ-পাতাল ফারাক। হাসপতালের বেড, আইসিইউ, হাই-ফো নাজাল ক্যানুলা সম্পর্কে দিনের পর দিন অসত্য তথ্য প্রকাশ করে যাচ্ছে।
বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে নাজাল ক্যানুলার সংখ্যা অধিদপ্তর বলছে, ৪ বাস্তবে আছে ২। নড়াইল হাসপাতালে উল্লেখ করা হয় ২০০ টি, বাস্তবে আছে ২ টি (অচল)। নওগাঁ সদর হাসপাতালে ৩টি, বাস্তবে একটিও নেই, জয়পুরহাটে ২ টি, বাস্তবে একটিও নেই (প্রথম আলো-৩/৭/২১)। আইসিইউ বেডের অনেকগুলোই ব্যবহার অনুপযোগী, কোথাও সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই, হাই-ফো নাজাল ক্যানুলা নেই, কোথাও চিকিৎসক নেই। অর্থাৎ এই আইসিইউ থাকা আর না থাকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই! অনেক সাধারণ বেড ব্যবহার অনুপযোগী। এসবই তালিকাভূক্ত করে প্রচার করছে। এই লুকোচুরি খেলা, বিপর্যয়কে আরো ভয়াবহ করছে।
ইতিমধ্যে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই মৃত্যুর দায় কে নিবে?? ২৫তম সপ্তাহ থেকে ২৬তম সপ্তাহে (এপিডেমিওলজিকাল সপ্তাহ,২০২১) শনাক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে ৫১.২৯%, মৃত্যু ৪৬.৩৪%। শনাক্তের হার ১৯.৮৫% থেকে হয়েছে ২৫.১৩% (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)। এ ধারা যদি পরবর্তী সপ্তাহে অব্যাহত থাকে তবে ঢাকাসহ দেশের অন্য সকল হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যা, আইসিইউ পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।
চরম সংকটের মুখোমুখি হবে গোটা দেশ।
ইতিমধ্যে ঢাকায় কোভিড ডেডিকেটেড অন্যতম পাঁচটি হাসপাতালের আইসিইউ খালি নেই। ঢাকায় সরকারী- বেসরকারী মিলিয়ে মোট সাধারণ বেডের ৫০.৫৪%, আইসিইউ ৬৬.৪২% পূর্ণ হয়ে গেছে। সারাদেশে মোট সাধারণ বেডের ৫৪.৭৭%, আইসিইউ’তে ৬৯.২৪% রোগী রয়েছে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর-৫/৭/২১)। বাস্তবে এটা আরো অনেক বেশি হবে। কারণ মোট শয্যার হিসাবে গড়মিল আছে, যেটা আগেই উল্লেখ করেছি। আমরা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছি।
হাসপাতালগুলোতে বেডের সংকট তৈরি হবে এটা দৃশ্যমান। বাংলাদেশের বাস্তবতায় হোম আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন অবাস্তব একটি বিষয়। পরিবারে একজন সংক্রমিত হলে অন্য সকল সদস্য আক্রান্ত হচ্ছেন, এর একটিই কারণ হোম আইসোলেশন কার্যকর হচ্ছে না। হাসপাতালের শয্যা সংকট ও গণহারে সংক্রমণ প্রতিরোধে অন্যতম উপায় দ্রুত ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলা। এটা এখনই প্রয়োজন। কিন্তু সরকার নির্বিকার, হয়তো করবে আরো অনেক বেশি ড্যামেজ হবার পর!! করোনা প্রতিরোধের মূল বাণী, সবসময় করোনার আগে আগে থাকতে হবে, ভূমিকা হতে হবে এ্যাগ্রেসিভ! আমরা ঠিক তার উল্টো!
বর্তমান লকডাউনে গণপরিবহণ বন্ধ। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে টেস্টে। খেয়াল করলে দেখবো, ধীরে ধীরে টেস্ট কমে আসছে। গত ৩০ জুন টেস্ট হয়েছে ৩৫ হাজার ১০৫, লকডাউন শুরুর দিন ১ জুলাই ৩২ হাজার ৫৫, ২ জুলাই ৩০ হাজার ১২, ৩ জুলাই ২২ হাজার ৬৮৭ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)। অর্থাৎ লকডাউনকালীন এই সময়ে ধারাবাহিকভাবে টেস্ট কমতে থাকবে। ফলশ্রুতিতে শনাক্তও কমবে। লকডাউন সফল করার অন্যতম একটি শর্ত, এই সময়ে টেস্ট সর্বোচ্চ বৃদ্ধি করে শনাক্তের ভিত্তিতে আইসোলেশনে নিয়ে যাওয়া।
বর্তমানে প্রয়োজন রাজধানী-জেলা শহরের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র পর্যন্ত বিনামূল্যে এ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা করা। যাতে গণপরিবহন বন্ধের প্রভাব টেস্টে যেয়ে না পড়ে। দেশের বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রতিদিন নুন্যতম ৫০ হাজারের অধিক টেস্ট করা। বর্তমান সময়ে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলে লকডাউন কোনভাবেই অর্থবহ হবে না। কারণ লকডাউন করার লক্ষ্য শুধুমাত্র নাগরিকের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা নয়!
সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন,‘গত ঈদে মানুষ গ্রামে গিয়েছিল বলেই সংক্রমণ বেড়েছে’। ন্যায্য কথা!
কিন্তু আমার প্রশ্ন, আপনারা যেতে দিলেন কেনো?? যেতে যাতে না পারে তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি কেনো?? গত ২২ জুন থেকে শুরু হওয়া ঢাকার পার্শ্ববর্তী ৭ জেলায় লকডাউন দিয়ে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, কিন্তু ১ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছেড়েছে এবং ঢুকেছে, সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে দিলেন কেনো??
তখন সেটি বন্ধ হয়নি, অথচ ১ জুলাই থেকে বন্ধ হয়েছে। অর্থাৎ ২২ জুন থেকে ঢাকায় ঢোকা ও বের হওয়া ঠেকাতে লকডাউনের নামে যে বিধি-নিষেধ জারি করেছিলেন সেটি ছিলো কাগুজে। নীতিগতভাবে চেয়েছেন ঢুকুক-বের হোক, যেমনটি গত ঈদের সময় চেয়েছিলেন। ১ জুলাই ঘাট এলাকা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। অর্থাৎ সরকারের কাছে ফাঁকা করার মেকানিজম আছে।
পরিতাপের বিষয়, সময়মত প্রয়োগ করে না। গত ঈদের সময় বা ২২ জুন থেকেই আজকের এই মেকানিজম প্রয়োগ করলে সংক্রমণের বিস্তার আরো অনেক কম হত! দেশব্যাপী এই লকডাউনেরও প্রয়োজন হত না। সেটি প্রয়োগ না করে সংক্রমণ বিস্তারে বরং ভূমিকা রেখেছেন। এটি না করলে করোনা প্রতিরোধে অন্য সকল ব্যর্থতাকে আড়াঁল করে জনগণের কাঁধে দায় চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হত না।
বিদেশগামী ও বিদেশ ফেরত যাত্রীদের জন্য আভ্যন্তরীণ ফাইট ওপেন করা হয়েছে। বিদেশগামীদের বিষয় বুঝলাম! বিদেশ ফেরত? এদের তো বিদেশ থেকে ফেরার পর ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকেই হোটেলে কোয়ারেন্টাইন থাকার কথা নূন্যতম ৭ দিন। তাহলে এখন থেকে কী বিদেশ ফেরতদের কোয়ারেন্টাইন উইথড্র করা হল? তা না হলে
ট্রানজিট রুট হিসাবে তারা কিভাবে ফাইট সেবা প্রাপ্ত হবে??
করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু অনেক বেড়ে গেছে। প্রথম থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিষয়টি হিসাবের বাইরে রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জেলা সিভিল সার্জন অফিস গুলোতে সংখ্যা তালিকভূক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয়ভাবে কোন তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না।
হাসপাতালের বাইরে বিশেষকরে গ্রামে উপসর্গ নিয়ে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, যাদের সংখ্যা কোথাও যোগ হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিজিএস এর অধীন বিপিও’র (পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে) ২৬ জুনের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে এ পর্যন্ত করোনা উপসর্গ নিয়ে মোট মৃত্যু ২ হাজার ৪৫৩। জুলাই মাসের প্রথম ৫ দিনে উপসর্গ নিয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ডে মারা গেছে ৫৪ জন, গত এক সপ্তাহে যশোর সদর হাসপাতালে ৬৬, মেহেরপুরে ২৭, কুষ্টিয়াতে ১৯, চুয়াডাঙ্গায় ১৯, সাতক্ষীরায় ৫১ জন মারা গেছে (সংশ্লিষ্ট জেলা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য)। এভাবে ৩৭ জেলায় প্রতিদিনই উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছে। যা কোথাও কোথাও নিশ্চিত মৃত্যুর সংখ্যার চাইতেও বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচিত প্রতিদিন করোনা উপসর্গে যে মৃত্যু ঘটছে তার পরিসংখ্যান প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় এ মুহুর্তে সবচেয়ে জরুরি, সমন্বিত রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। জনস্পৃক্ততা ব্যতীত করোনা প্রতিরোধ সম্ভব নয়। আমলা নির্ভর প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সেটি একেবারেই অসম্ভব। সেজন্য প্রয়োজন সমন্বিত রাজনৈতিক উদ্যোগ, তার অধীনে সকল শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিকে ঐক্যবদ্ধ করে যৌথ কর্মকৌশল নির্ধারণ করা। জনস্বাস্থ্যবিদদের পরামর্শ নির্মোহভাবে পালন করা।
জনবান্ধব করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ব্যতীত অন্য কোন পদ্ধতিতে করোনা সংক্রমণ মোকাবেলা সম্ভব নয়।
সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় যুব পরিষদ