করোনা: লকডাউন নাটক

0
216

আবু নাসের অনীক

২৬ জুন রাতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানা গেল, ২৮ জুন থেকে কঠোর লকডাউন।

পরের দিন দুপুর নাগাদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানালো, ২৮ তারিখ থেকে সীমিত পরিসরে, ১ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউন। লকডাউনের মত একটি গুরুত্বপূর্ন নীতিনির্ধারণ সিদ্ধান্ত যাদের কয়েক ঘন্টার মধ্যে রিসিডিউল করতে হয়, তারা করোনা প্রতিরোধে অদ, অযোগ্য সেটা বিনা তর্কেই বলা যায়।

বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতির প্রেেিত ২৪ জুন সরকারের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে আগামী ১৪ দিন শাটডাউনের সুপারিশ পাঠানো হয় সরকারের কাছে।

কমিটির সুপারিশের প্রেেিত জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন,‘সরকারেরও ইতিমধ্যে এই ধরনের প্রস্তুতি আছে। সরকারও কঠোর বিধিনিষেধের চিন্তা করছে। যেকোন সময় সরকার তা ঘোষণা দেবে’। তাঁরা অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে সেটি ঘোষণাও দিয়েছে এবং কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সেটি পরিবর্তনও করেছে। কতোটা অস্থির-অদুরদর্শী হলে এমনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে!

২৮ তারিখ নতুন জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে সকল ধরনের সরকারী-বেসরকারী অফিস খোলা রেখে গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনে সিদ্ধান্ত যে কতোটা গণবিরোধী তা ইতিপূর্বেও প্রমাণিত হয়েছে।

যারা গণপরিবহনে (বাস) যাতায়াত করে, মাসের শেষ সপ্তাহে তাদের পকেটে এমনিতেই টাকা-পয়সা থাকে না। ৩০/৪০ টাকার বাস ভাড়ার পরিবর্তে যদি ৩০০/৪০০ টাকা রিক্সাভাড়া দিয়ে কর্মস্থলে যাতায়াত করতে হয়, এর চেয়ে অমানবিকতা আর কী হতে পারে!! মাস শেষে বেতন পাবারও নিশ্চয়তা নেই!

গণপরিবহন বন্ধ করা হয়েছে ফ্রিকোয়েন্ট মুভমেন্ট ঠেকানোর জন্য। কিন্তু অফিস-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-গার্মেন্টস খুলে রেখে গণপরিবহণ বন্ধ করলেও মুভমেন্ট বন্ধ বা কমা কোনটিই ঘটে না সেটা পাগলেও বোঝে!

তাহলে, সরকার কি বোঝে না?? সরকারও বোঝে! কিন্তু এই সরকার যারা চালাচ্ছে (প্রশাসন-আমলা) তাদের জনস্বার্থ নিয়ে ভাবনা নেই। নেই বলেই, লকডাউনের মত স্পর্শকাতর বিষয়ে হুটহাট করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেটি পরিবর্তনও করতে পারে। ফলাফলে কতো জায়গায় অব্যবস্থাপনা তৈরি হয় সেটি জাজম্যান্টও করে না। সরকারে জনপ্রতিনিধিদের তুলনায় আমলারা এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ২৮ জুন সরকার দলীয় জ্যৈষ্ঠ সাংসদ তোফায়েল আহমেদ সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন,‘এতে রাজনৈতিক সরকার ও রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব ম্লান হয়ে যায়’।

আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া লকডাউনের বিষয়ে মন্ত্রী পরিষদ সচিব জানিয়েছেন, জরুরি পরিষেবা ছাড়া সবকিছুই বন্ধ থাকবে। গত ২৬ তারিখে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, লকডাউনে প্রতিবারের ন্যায় এবারও সরকার গার্মেন্টস খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছে। ল করুন, সরকার কোন বক্তব্য দেবার আগেই তারা তাদের মতো করে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছে। ২৮ তারিখে গণমাধ্যমকর্মীদের এই বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রীপরিষদ সচিব বলেন,‘এ বিষয়ে এখনো চুড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত হয়নি’।

এটা খুবই স্পষ্ট যে, গার্মেন্টস মালিকদের এ ধরনের ধৃষ্টতামূলক আচরণ করাটা স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ বর্তমান গণবিরোধী সরকার তাদের মত লুটেরা পুঁজিপতি আর আমলাদের আশ্রয়ে টিকে আছে।

সুতরাং তাদেরকে সকল ধরনের অবৈধ সুযোগ দিতে সরকার বাধ্য। সেকারণেই সরকারের বক্তব্য দেয়ার আগেই তারা বক্তব্য দেয় এবং সরকার নিশ্চুপভাবে সেটা হজম করে। এটাকে বলা হয় ‘এ্যাবোভ দ্যা গভর্নমেন্ট’ আর আমলাদের কর্মকান্ডকে বলা হয় ‘গভর্নমেন্ট ইন দ্যা গভর্নমেন্ট’। এই দুই অংশের গাইডেই সরকার পরিচালিত হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যখন বলছেন, সবকিছু বন্ধ করে দিতে হবে, তার বিপরীতে গার্মেন্টস মালিকরা বলছে, গার্মেন্টস বন্ধ করলে কর্মীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে। যুক্তি হিসাবে উপস্থাপন করছে, শ্রমিকরা বাড়ি চলে যাবে। একবার একটা পরিস্থিতি তৈরি করে সেটা এখন সমানে ক্যাপিটিলাইজ করছে। কিন্তু সরকার চাইলে আরিক অর্থেই ঢাকা থেকে একটি মাছি যেমন বের হতে পারবে না, একইরকমভাবে ঢুকতেও পারবে না।

বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার সেটা চাইছে না। ঢাকাকে সুরতি রাখার যুক্তি তুলে ধরে পার্শ্ববর্তী ৭ জেলায় ২২ জুন থেকে লকডাউন চলছে। কিন্তু এই কয়েকদিনে ঢাকা থেকে মানুষ বের হওয়া বা ঢোকা কোনটাই বন্ধ হয়নি। যেভাবে মানুষ সংক্রমিত জেলাগুলোতে ছুটে যাচ্ছে তাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণহীন জায়গায় চলে যাচ্ছে। এই সময়ে সংক্রমণ প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কিন্তু সরকারের হাতে এই ঢোকা ও বের হওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার মেকানিজম থাকার পরেও সেটা প্রয়োগ করছে না। জনগণের দুর্ভোগকে বাড়িয়ে তুলছে, একইসাথে সংক্রমণ আরো বেশি বিস্তারের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করছে।

ঈদের আগে মার্কেট খুলে দেওয়া, বিশৃঙ্খলভাবে বাড়ি যাওয়া, সময়মতো সীমান্ত সীল না করা, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশন ব্যবস্থা পরিপূর্ণ নিরাপত্তাসহ নিশ্চিত না করার ফলাফল এখন আমরা পাচ্ছি। সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই পরিস্থিতি এড়াতে পারতো, কিন্তু করেনি, এখনও করছে না। কারণ, করলে জনগণের উপর দায় চাপানো যেতো না। টিকা’র ব্যবস্থা করতে না পারা, পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারাসহ সকল ব্যর্থতা আড়াল করে অতি সহজেই জনগণের কাঁধে দায় চাপিয়ে দেওয়া যায়। আর জনগণও সেই দায় মাথায় নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে!! এভাবে আর কতোদিন এই চোর-পুলিশ খেলা!!

কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, কোন প্রকার তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই ঢাকাসহ দেশব্যাপী লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৩ জুন ঢাকায় শনাক্তের হার ছিল ৯%। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২৫ জুন শনাক্তের হার হয়েছে ২১%। ২৯ জুন দেশের মোট শনাক্তের ৪০% ঢাকা বিভাগে, এর মধ্যে ঢাকা মহানগরসহ জেলায় ৭৩.৮২%। ২১ জুন আপলোড করা আইসিডিডিআরবি’র জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্যানুসারে ৩৪ টি নমুনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে যার মধ্যে ১৬ টি নমুনা ঢাকার। ২৬ জুন চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আপলোড করা জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্যানুসারে ৬ টি নমুনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে যার মধ্যে ৫ টিই ঢাকার (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)।

কেউ বলছেন, ঢাকায় ৭১% এন্টিবডি ডেভলপ করেছে, সুতরাং এখানে লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা নেই। আইসিডিডিআরবি’র গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় তিনটি বস্তি এবং ঐ বস্তি এলাকার আশপাশ এলাকায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। ঢাকায় মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ১৭ লাখ, এরমধ্যে বস্তিতে বসবাস করে ৬ লাখ ৪৬ হাজার, যা ঢাকার মোট জনসংখ্যার ২.১৯% (বিবিএস)। এই গবেষণার মাধ্যমে কী কোনভাবে বলা যায়, ঢাকায় যথেষ্ঠ এন্টিবডি ডেভলপ করেছে, এজন্য এখানে লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা নেই!!

গবেষণা সম্পর্কে আইসিডিডিআর’বি বলেছে,‘এর অর্থ হচ্ছে, নির্দিষ্ট এই এলাকাগুলোতে কী পরিমান মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে একটা ধারণা মিলেছে এই জরিপের ফলাফলে’। ঢাকায় বর্তমানে সংক্রমণের হার-সংখ্যা এবং এই গবেষণার ফলাফল এর কোনটিই এটা প্রমাণ করে না যে, ঢাকায় এই মুহুর্তে লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা নেই।

গত সপ্তাহের পূর্বের সপ্তাহে রোগী (১৩-১৯ জুন) শনাক্ত হয়েছিলো ২৩ হাজার ৫৪১। গত সপ্তাহে (২০-২৬ জুন) শনাক্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ১১১। আগের সপ্তাহের তুলনায় শনাক্ত বেড়েছে ৪৯.১৫%। গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছে ৩৯৫ জনের, গত সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছে ৫৮৭ জন। অর্থাৎ মৃত্যু বেড়েছে ৪৮.৬১% (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)। এ ধরনের একটি পরিস্থিতি বিবেচনায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি শাটডাউনের সুপারিশ করেন।

শাটডাউন বলি আর লকডাউন, এটি সর্বাত্বক একটি বিষয়। সমস্যার জায়গাটি হচ্ছে, যারা সরকার চালায় তারা এটি কেয়ার করে না। তাদের কারণেই সংক্রামক আইন পপাতদুষ্টভাবে প্রয়োগ করা হয়।

পূর্বের লেখাগুলিতে বলেছি, সরকার আইন ভঙ্গ করে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে জনগণও। এটা খুবই স্পষ্ট বিষয়, নিজে আইন প্রতিপালন না করলে অন্যকে দিয়ে বল প্রয়োগ করেও সেই আইন প্রতিপালন করানো যায় না!

পূর্বের লকডাউনের মত এবারও দেখা যাবে, ব্যক্তিগত গাড়ী চলাচল ঠেকাতে ব্যর্থ হবে। যথারীতি জরুরি পরিষেবার বাইরেও বেসরকারী বিভিন্ন অফিস খোলা থাকবে, কোন মনিটরিং থাকবে না। এ সমস্ত অফিসগুলোর মধ্যম আর নিম্ম শ্রেণীর কর্মীরা গণপরিবহন না পেয়ে নাজেহাল হবে। সরকার নির্বিকার দশর্কের ভূমিকা পালন করবে। ৩ দিনের মাথায় সাধারণ জনগণ সবাই বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে যে যার মতো চলাচল করবে!!

সরকার চোটপাট করবে প্রান্তিক অংশের মানুষের উপর। তাদেরকে নাজেহাল করবে। এই নাজেহাল করাটা ন্যায্যতা পেতো যদি তারা রাষ্ট্রের সকল অংশের নাগরিকের সাথে একই আচারণ করতো। অবশ্য সেটা প্রত্যাশা করাও যায় না। কারণ এই রাষ্ট্র প্রতিনিধিত্ব করে লুটেরা-টাকাওয়ালাদের। সুতারং এরা অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করবে, আইন ভঙ্গ করবে এটাই স্বাভাবিক।

সরকারের যেটা বোধের মধ্যে আসছে না, সেটি হল সংক্রমণ পরিস্থিতি যে পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে, তাতে এই লুটেরা’রা সরকারকে রা করতে পারবে না। একইসঙ্গে এটাও প্রযোজ্য, যে লুটপাট তারা অব্যহত রেখেছে সেটি খুব বেশিদিন চালাতে পারবে না। সংক্রমণ যদি ভারতের ধারে কাছেও পৌছায় তবে দেশের সব কিছুই ম্যাসেকার হয়ে যাবে।

উন্নয়নকর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here