লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল, শালিখা
বন্যা, অপরিকল্পিত বাঁধ, দখলদারদের দখল, ময়লা-আর্বজনা, কচুরিপানা জমাট ও নদীর বুকে ধান চাষ এর ফলে নদীর তলদেশ শুকিয়ে নাব্যতা হারিয়ে বিলুপ্তী হতে চলেছে মাগুরার শালিখা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ফটকি ও চিত্রা নদী। সংস্কারের অভাবে এ নদী দুটি প্রায় মৃত হতে চলেছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এ অঞ্চলের সুস্বাদু দেশীয় প্রজাতীর সকল প্রকার মাছ ও জীব বৈচিত্র। বিঘœ ঘটছে কৃষি জমিতে সেচ দানে।
নদী দুটি সংস্কার হলে কৃষি জমিতে সেচ সুবিধাসহ রক্ষা পাবে ওই এলাকার জীববৈচিত্র। যা আর্থ-সমাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এককালের প্রবাহমান খরস্রোতা শালিখার ফটকি ও চিত্রা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে শুকিয়ে নাব্যতা হারিয়ে প্রায় মৃত অবস্থা।
ফটকি নদীটি ভারতের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে পশ্চিম বাংলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অতপর ঝিনাইদহ, কালিগঞ্জের মধ্য দিয়ে মাগুরা সদর ও শালিখা উপজেলার সীমান্ত ঘেঁষে ধনেশ্বরগাতী, ভাটোয়াইল, আড়পাড়া, শলই ও বরইচারা হয়ে বুনাগাতীর সোনাকুড়ে চিত্রা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪৯ কিঃমিঃ। অপর দিকে, চিত্রা নদীটি চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ শালিখা উপজেলার দক্ষিন সীমানা ঘেঁষে নড়াইল জেলার মধ্যগোপাল গঞ্জের দিকে ধাবিত হয়েছে। ত্রিশ বছর আগেও এ নদী দুটি ছিলো অত্র এলাকার গর্ব । এ নদীর উপর ভর করে প্রসার ঘটেছিলো এলাকার ব্যবসা বানিজ্যের।
এ নদীর জন্যই এক কালের মাগুরা সদর উপজেলার মঘী ইউনিয়নের ভাবনহাটি বাজার, শালিখা উপজেলার সীমাখালী, হাজরাহাটি, বুনাগাতী, গড়েরহাট, পুলুম ও গঙ্গারামপুর বাজার ছিলো অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র।
খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বড়-বড় পাল তোলা নৌকা আসতো এ এলাকায় ধান, পাট, আম, কাঁঠাল, বেল, খেজুর গুড় সহ বিভিন্ন কৃষি পন্য ক্রয় করতে। একই সাথে নদী দুটির সাথে সংযুক্ত খাল গুলি দিয়ে ডিঙ্গি নৌকা করে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা তাদের কৃষি পন্যসহ বিভিন্ন পন্য সামগ্রী বাজারে বিক্রয়ের জন্য আনতো।
এছাড়া এ নদী দুটি শুকানোর সাথে-সাথে সংযুক্ত প্রায় ৩০টি খাল ও ২০টি বিল এখন কৃষি জমিতে পরিনত হতে চলেছে। নদীসহ এসকল খাল-বিলে পাওয়া যেতো বিভিন্ন প্রকার দেশীয় প্রজাতির মাছ। দেশীয় প্রজাতীর মাছের মধ্যে পুঁটি, ট্যাংরা, কৈ, শিং, পাবদা, বাইন, খয়রা, ফলই, রয়না, টেপা, চাঁদা, শৈল, গজার, কালবাউশ, চিতল, রুই, মৃগেল, কাকলে, বোয়াল প্রভৃতি দেশীয় প্রজাতীর মাছ পূর্বে পাওয়া যেতো, যা এখন বিলুপ্তীর পথে। পূর্বে এ নদী দুটিতে ডলফিন দেখা গেছে, যা এখন আর দেখা যায়না। শুধু তাই নয় নদী ও খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ার সাথে-সাথে সকল জীব বৈচিত্রও হারাতে বসেছে।
এলাকাবাসী জানান, ফটকী ও চিত্রা নদী খনন হলে বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় জনসাধারণের গোসলের জন্য ও জেলেদের মাছ ধরা বৃদ্ধির সহায়ক হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের নিরাপদ জীবনযাত্রা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি নদী তীরবর্তী এলাকাবাসী কৃষি জমিতে সেচ সুবিধাসহ শুষ্ক মৌসুমে নানা কাজে নদীর পানি ব্যবহার করতে পারবে। জেলা পানি উন্নয়নবোর্ডের দেয়া তথ্য মতে, চুয়াডাঙ্গা জেলার মাথাভাঙ্গা নদী থেকে নব গঙ্গা হয়ে ফটকী ও চিত্রা নদীর উৎপত্তি।
ভারতের উজান থেকে পানি প্রবাহ কমে যাওয়া, নদীর বিভিন্ন অংশে অপরিকল্পিত বাঁধ ও ব্রিজ নির্মাণ, নদীতে ধান চাষ ও পলি পড়ে নদী ভরাট হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে নদী দুটি। যে কারনে নদীর বিভিন্ন স্থানে জেগে উঠেছে চর। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় নদীর তলদেশে পলি জমে উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মাগুরা জেলার শালিখার কৃষি জমির জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে ও নদীতে দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদনের জন্য নদী দুটি পুনঃখনন করা অত্যন্ত জরুরী।
মাগুরা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান সুজন বলেন, ফটকী ও চিত্রা নদী খননের জন্য বরাদ্ধ পাঠানো হয়েছে। আর শালিখায় ব্যাঙ নদী বলে কোন নদী আমাদের রিকর্টে নেই। আমি আশা করছি ফটকী ও চিত্রা নদীও খনন প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এত একদিকে যেমন জীববৈচিত্র, প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং পরিবেশ রক্ষা পাবে। পাশাপাশি কৃষি জমিতে সেচ কার্যক্রম চালানোসহ নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে অবদান রাখবে।
নদীর সংস্কারের অভাবে বর্ষা মৌসূমে প্লাবিত হয়ে দুই পাড় ভেসে হাজার-হাজার একর ফসলী জমি ও ঘর-বাড়ি তলিয়ে যায়। ফলে প্রতি বছরই নদী পাড়ের মানুষদের পোহাতে হয় চরম দূর্ভোগ। আবার শুস্কো মৌসূমে নদী গুলি শুকিয়ে যায়। ফলে নৌযান চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
ফটকী বাঁচাও চিত্রা বাঁচাও আন্দোলনের রূপকার শ্রী ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বলেন, ফটকী ও চিত্রা নদীর সংস্কার অতীব জরুরী। কারন দেশী প্রজাতির মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। পরিবেশ দিন দিন উষ্ণ হয়ে উঠছে। সুতরাং ফটকী ও চিত্রা নদীর সংস্কার ব্যতিরেখে শালিখা উপজেলার তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব নয়।
তিনি আরো বলেন, এমনিতেই উপজেলার শতখালী গ্রামের মধ্যে দিয়ে অবস্থিত ব্যাংঙ নদী দখলদারদের দখলে রয়েছে। এসব দখলদাররা ব্যাঙ নদীটি পুরোটাই দখল নিয়েছে। যা এখন নদীটির অস্থিতই খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যে নদী দিয়ে এক সময় শালিখার মানুষ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পর্যন্ত যেতে পারতো।