হিন্দু মন্দিরের নিরাপত্তার নামে ভারতে মুসলিমদের উচ্ছেদের চেষ্টা

0
210

সত্যপাঠ ডেস্ক

ভারতের উত্তরপ্রদেশে একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নামে প্রশাসন ওই এলাকার ডজনখানেক মুসলিম পরিবারকে জোর করে তাদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করতে চাইছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ঘটনাচক্রে গোরখপুরের ওই মন্দির ও মঠের বর্তমান প্রধান হলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথ।

মন্দিরের লাগোয়া এলাকায় বসবাস করেন, এমন একাধিক মুসলিম পরিবার বিবিসিকে জানিয়েছে তাদের ভয় দেখিয়ে বা ভুল বুঝিয়ে বাড়ি খালি করার সম্মতি আদায় করা হয়েছে।

কিন্তু তারা তাদের বহু বছরের ভিটেমাটি আদৌ ছাড়তে চান না এবং ওই এলাকায় ‘বাবা’ বলে পরিচিত স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কাছেই তারা এর প্রতিকার দাবি করছেন।

গোরখপুরের প্রশাসন অবশ্য এলাকার মুসলিম বাসিন্দাদের জোর করার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে।

গোরখপুরের বিখ্যাত গোরক্ষধাম মন্দিরকে ঘিরে যে ঘিঞ্জি এলাকা, তারই এক কোণায় এগারোটি মুসলিম পরিবারের বাস অন্তত গত দেড়-দুশো বছর ধরে।

মন্দিরের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য ওই এলাকাটি খালি করে সেখানে পুলিশ মোতায়েন করতে হবে, এই যুক্তিতে প্রশাসন সেখানে বাসিন্দাদের বাড়ি বাড়ি যেতে শুরু করে দিনদশেক আগে।

এমনই একটি পরিবারের কর্তা মুশির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “প্রশাসনের লোকজন এসে আমাদের বলতে থাকেন, এই রাজ্যে মুখতার আনসারি বা আজম খানের মতো মাফিয়ার বাড়িও সরকার খালি করে দিয়েছে – কাজেই প্রশাসনের সঙ্গে টক্কর নিয়ে কোনও লাভ হবে না।”

“পরদিন এসে আমাদের সই নিয়ে যায় বাড়ি খালি করানোর সম্মতিপত্রে – বলা হয় সার্কল রেটের দ্বিগুণ বা তিনগুণ ক্ষতিপূরণও নাকি দেবে।”

“কিন্তু এই বাড়িতে আমরা আছি আমাদের বাপ-দাদাদের সময় থেকে, এখানেই আমাদের দোকান, আটার চাক্কি, বসবাস – এটা আমরা কীভাবে ছেড়ে যেতে পারি?”

পাশের আর একটি বাড়ির গৃহবধূ নাদিরা বেগম বলছিলেন, “পৈতৃক বাড়ি আমরা কিছুতেই ছাড়ব না। দরকারে ‘বাবা’, অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের সঙ্গে কথা বলেই ফয়সালা করব।”

“প্রথমে আমাদের একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল সই করতে, সেটা নাকি শুধু ফর্ম্যালিটি, আমাদের কোনও ক্ষতি হবে না – পরে বলছে আমাদের নাকি বাড়ি খালি করতে হবে। তো এটা আমরা কীভাবে মানতে পারি?”

গোরক্ষধাম মন্দিরের বর্তমান মোহন্ত বা প্রধান আদিত্যনাথই এখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী – তার কাছেই এখন এই উচ্ছেদ-চেষ্টার বিহিত চান এই মুসলিম পরিবারগুলি।

নূর মহম্মদ যেমন বলছিলেন, “তহসিল অফিসে গিয়ে আমরা আশ্বাস পেয়েছি, কোনও জোর-জবরদস্তি নেই, চাইলে আমরা না কি সই প্রত্যাহার করে নিতেই পারি যে কোনও সময়।”

“আমাদের সব সমস্যায় আমরা সরাসরি ‘বাবা’র সঙ্গেই আগে কথা বলি, এখানেও তাই বলব।”

তার প্রতিবেশী মোহাম্মদ ইমরানও বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার আগে তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চান না।

কিন্তু এই এগারোটি পরিবারের মধ্যে অন্তত নটিকে জোর করে বাড়ি খালি করানোর মুচলেকায় সই করানো হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়াতে এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই প্রশাসন এখন রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়েছে।

গোরখপুরের সদর তহসিলদার সঞ্জীব দীক্ষিত জানিয়েছেন, “মন্দিরের নিরাপত্তা পরিকল্পনা মোটেই চূড়ান্ত হয়নি – এখন শুধু বাসিন্দাদের সম্মতি নেওয়া হচ্ছে ও কাউকে জোর করার প্রশ্নও উঠছে না।”

তবে উত্তরপ্রদেশের ভোটের মাত্র সাত-আট মাস আগে এই পদক্ষেপকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের আর একটি চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন ওই রাজ্যের রাজনীতিবিদ আদিল শাহনওয়াজ খান।

মি খান বিবিসিকে বলছিলেন, “এর মাধ্যমে ভোটের আগে হিন্দু সমাজকে একটা বার্তা দেওয়ারই চেষ্টা হচ্ছে যে সরকার শুধু তোমাদেরই পাশে আছে, অন্যদের পাশে নেই।”

ভারতে গোরক্ষধাম মন্দির থেকে অমরনাথ যাত্রার মতো ধর্মীয় ঐতিহ্যে হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থানের যে পরম্পরা আছে, তার এর ফলে বিপন্ন হবে বলে মনে করেন আদিল শাহনওয়াজ খান।

গোরখপুর শহরের সিনিয়র সাংবাদিক ও স্থানীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শফি আজমি আবার বিষয়টিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন।

মি আজমি বিবিসিকে বলছিলেন, “দিনকয়েক আগেই মন্দিরের সামনে রাস্তা ফোর-লেন করা হয়েছে, যাতে অনেক ঘর ভাঙা পড়েছে এবং মোহন্ত নিজেও মন্দিরের দেওয়াল ভেঙে দিয়েছেন।”

“তখন হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের লোকই সেখানে ছিল বলে সেটা ইস্যু হয়নি।”

“কিন্তু এখন এই এগারোটি পরিবার মুসলিম, তাদের সম্মতি চাওয়া হচ্ছে বলেই এটিকে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়া হচ্ছে।”

যোগী আদিত্যনাথ নিজে হস্তক্ষেপ করলে কীভাবে বিষয়টির রফা হয় তা অবশ্যই দেখার।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here