কায়সুল খান
পশ্চিম ইউরোপের আইবেরীয় অঞ্চলের ছোট্ট দেশ পর্তুগাল। দেশটির উত্তর ও পূর্বে স্পেন এবং পশ্চিম ও দক্ষিণে আটলান্টিক মহাসাগরের অবস্থান। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের ন্যায় পর্তুগালও ২০২০ সালে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শিকার হয়। ২ মার্চ, ২০২০ তারিখে ইতালিতে অবকাশ যাপন করে ফেরা ৬০ বছর বয়সী একজন চিকিৎসক ও স্পেনে কাজ করা ৩৩ বছর বয়সী একজন পর্তুগিজ নাগরিকের শরীরে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। পর্তুগালে ৪ জুন, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত ৮,৫১,৪৬১ মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে ১৭,০২৯ জন মানুষ কোভিড-১৯ এ মৃত্যুবরণ করেছেন। অন্যদিকে সুস্থ হয়েছেন ৮,১০,৯৫৯ জন।
গত বছর পর্তুগালের প্রতিবেশী দেশ স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালিতে করোনা ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লেও পর্তুগাল অনেকটা নিরাপদ ছিল। পর্তুগালে করোনা ভাইরাস শনাক্তের পর দেশটির সরকার দ্রত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২০২০ সালের ১২ মার্চ দেশ ব্যাপী সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয় এবং ১৮
মার্চ থেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট স্টেট ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেন। ফলে করোনা ভাইরাসের প্রথম ঢেউ বেশ সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয় পর্তুগাল। পরিস্থিতির উন্নতি হলে একই বছরের ২ মে থেকে স্টেশ ইমার্জেন্সি তুলে নেয়। তবে একই সাথে জনগণের জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করে সরকার। যেমন –
মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করা, ১০ জনের বেশি মানুষের একত্রিত হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা প্রদান, দোকান ও রেস্তোরা রাত ৮ টার মধ্যে বন্ধ করা, প্রকাশ্যে অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় পানে নিষেধাজ্ঞা, রেস্তোরায় বসে খাবার গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এবং শুধুমাত্র টেক-অ্যাওয়ে চালু রাখা ইত্যাদি। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের
ফলে পর্তুগাল করোনা ভাইরাসের প্রথম ধাক্কা সাফল্যের সাথে সামলে নিতে সমর্থ হয়।
কিন্তু ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে পরিস্থিতির আবার অবনতি হয়। তাই বাধ্য হয়ে পর্তুগাল সরকার ১৪ অক্টোবর, ২০২০ তারিখ থেকে দেশব্যাপী দুর্যোগকালীন সতর্কতা জারি করে। মুলত গত বছরের অক্টোবর থেকে পর্তুগালে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত করতে শুরু করে। এ সময় করোনা ভাইরাসের প্রথম
ঢেউয়ের ১০ গুণ বেশি মানুষ সংক্রমিত হতে শুরু করে। ফলে পর্তুগিত সরকার আবার কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।
করোনা ভাইরাসের প্রথম ধাক্কায় দীর্ঘদিন দেশটিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। তবে প্রযুক্তির সহায়তায় এখানকার শিক্ষার্থীদের অনলাইন মাধ্যমে ক্লাস চালু রাখার নির্দেশনা দেয় সরকার। মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত এভাবে ক্লাস করে এখানকার শিক্ষার্থীরা। সেপ্টেম্বর মাস থেকে আবারও ডে-কেয়ার, প্রাইমারি-হাইস্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল পর্যায়ে অন-ক্যাম্পাস ক্লাস শুরু হয়। তবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার পর আবার করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকলে সরকার আবারও অন- ক্যাম্পাস ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় এবং অনলাইন ভিত্তিক পড়াশোনা চালু করে। এই অবস্থায় বেশ কিছু দিন চলার পর দেশটিতে ১৫ মার্চ ২০২১ তারিখ থেকে অন-ক্যাম্পাস ক্লাস শুরু হয়।
করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে পর্তুগাল দেশটির রেকর্ড সর্বোচ্চ ৩০৩ জন মানুষের মৃত্যু রেকর্ড করে। এই সময় দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ হারে পৌছায় এবং ২৮ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে পর্তুগালে ১৬,৪৩২ জন মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। করোনার দ্বিতীয়
ঢেউয়ের সময়ে ৯ নভেম্বর ২০২০ তারিখ থেকে পর্তুগালে আবারও স্টেট ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হয় এবং ২৯ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে পর্তুগাল তাদের বর্ডার সিল করে দেয়। কেবলমাত্র বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে তখন পর্তুগিজ রেসিডেন্টরা অনুমতি গ্রহণ সাপেক্ষে পর্তুগালের বাইরে যাতায়াত করার সুযোগ পেতো। জানুয়ারি
মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে পর্তুগালের প্রতি মিলিয়ন নাগরিকের মধ্যে গড়ে ২৪৭ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এসময় দেশটিতে তীব্র মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। আইসিইউ বেডগুলো পূর্ণ হয়ে যায়। পর্তুগিজ সরকার বাধ্য হয়ে মরণাপন্ন রোগীদেরকে অষ্ট্রিয়া, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে আইসিইউ সম্বলিত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
পর্তুগাল করোনা ভাইরাসের সময় অত্যন্ত মানবিক রাষ্ট্রের পরিচয় দেয়। দেশটিতে নিয়মিত হতে আবেদন করা প্রায় ৪ লক্ষ অবৈধ নাগরিকের জন্য সমস্ত নাগরিক সুবিধা উন্মুক্ত করে দেয়। ব্যাংক একাউন্ট খোলা, সরকারি ভর্তুকি লাভ, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা গ্রহণের জন্য মেডিকেল নম্বর প্রদান সহ পর্তুগালের বৈধ নাগরিকদের প্রাপ্ত সমস্ত সুযোগ-সুবিধা এ সকল অবৈধ নাগরিকের জন্য বৈধ ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী অ্যান্তোনিয় কস্তার সরকার।
পর্তুগালে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রথম কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন/টিকা প্রদান করা হয়।
পোর্তোর সান জাও হাসপাতালে চিকিৎসক অ্যান্তনিও সারমেন্তো সর্বপ্রথম পর্তুগিজ হিসেবে করোনা ভাইরাসের টিকা গ্রহণ করেন। পর্তুগিজ সেবিকা ইসাবেল রেবিরো তাঁকে প্রথম ডোজের টিকা প্রদান করেন।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে কোভিড-১৯ এর টিকা প্রদান কার্যক্রম জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়।
পর্তুগাল সরকার ও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় বেশ কয়েকটি ধাপে টিকা প্রদানের ঘোষণা দেয়। সর্বপ্রথম ধাপে ৫০ বছরের অধিক বয়স্ক হার্ট, ডায়াবেটিস ও কিডনির জটিলতায় ভোগা নাগরিকদের টিকা প্রদান করা হয়। একই সাথে এসময় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবার জড়িত ব্যক্তিবর্গ কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের টিকা গ্রহণের সুযোগ পান। এ সময় ২৫০,০০০ নার্স এবং ৩০০,০০০ চিকিৎসক করোনা ভাইরাসের টিকা গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয় ধাপে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ১.৮ মিলিয়ন পর্তুগিজ মেডিকেল নম্বর (SNS Number) ধারী জনগণ করোনা ভাইরাসের টিকা লাভ করেন। একই সাথে ৫৫-৬৪ বছর বয়সী ৯০০,০০০ মানুষ যাদের হার্ট, কিডনি, লিভার, ব্লাড-প্রেসার কিংবা অন্যান্য জটিল শারীরিক সমস্যা আছে তারা টিকা গ্রহণ করেন।
পর্তুগালে বসবাসকারী বাদবাকি জনগণ যাদের বয়স ১৮ এর উপরে তারা তৃতীয় ধাপে করোনা ভাইরাসের টিকা গ্রহণের সুযোগ পান। বর্তমানে তৃতীয় ধাপের টিকা প্রদান কার্যক্রম চালু রয়েছে। পর্তুগিজ সরকারের SNS এর ওয়েব সাইটে ৪৫ বছরের অধিক বয়সের জনগণ করোনা ভাইরাসের টিকা গ্রহণের জন্য আবেদন করতে পারেন। এছাড়া ৪০+ বয়সের বাদবাকি নাগরিককে ০৬ জুন থেকে এবং ৩০+ বয়সী নাগরিকদের ২০ জুন থেকে করোনা ভাইরাসের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। ৩০+ বয়সী নাগরিকদের টিকা কার্যক্রম সম্পর্ন হলে আগামী জুলাই মাস থেকে ২০-২৯ বছর বয়সী নাগরিকদের টিকা প্রদান করা হবে।
১ কোটির কিছু সংখ্যক বেশি জনসংখ্যার দেশ পর্তুগালে ইতিমধ্যে প্রায় ৬০ লাখ নাগরিককে ন্যূনতম ১ ডোজ কোভিড-১৯ এর টিকা প্রদান সম্পন্ন হয়েছে। পর্তুগাল সরকার শুধুমাত্র ৬০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের জন্য অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ব্যবহার করছে। বাদবাদি নাগরিকের জন্য ফাইজার-বায়োএনটেক
এবং মর্ডানার টিকা প্রদান করছে।
টিকা কার্যক্রম চালু হওয়ার পর পর্তুগালে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছে। বর্তমানে এখানে দৈনিক সংক্রমণের গড় সংখ্যা মাত্র ৬০০ এবং মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়। ফলশ্রুতিতে পর্তুগালের আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। গত ১ মে ২০২১ তারিখ থেকে এখানে দোকানপাট, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ পুনরায় চালু হয়েছে। জনগণ ও পর্যটকদের জন্য বিশেষ পর্যটন স্পটগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দোকানপাট খোলা রাখার সময় রাত ৮ টা থেকে বাড়িয়ে ৯টা পর্যন্ত করা হয়েছে। আগামী ১৪ জুন থেকে অবশিষ্ঠ নিষেধাজ্ঞাও তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী।
পরিকল্পিত ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পর্তুগাল করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে সমর্থ হয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা জনগণ কঠোরভাবে পালন করেছে। একই সাথে পর্তুগালের পুলিশ বাহিনী, চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশাজীবীরাও জনগণকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করেছে। ফলশ্রুতিতে পর্তুগাল করোনা ভাইরাসে মোকাবেলায় ইউরোপের অন্যতম সফল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
Student
Master’s in International Development & Public Policy
Nova School of Business & Economics, Carcavelos, Portugal