আবু নাসের অনীক
৩১ মে এ দেশের সাম্প্রদায়িক বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা শহীদ জামিল আখতার রতনের ৩৩তম শহীদ দিবস। শহীদ জামিল সংগ্রাম করেছিলেন একটি একমূখী. বিজ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থার দাবিতে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চেতনায়। মেহনতী-শ্রমজীবী মানুষের রাজ কায়েমের লক্ষ্যে।
১৯৮৮ সালে মে মাসে তৎকালিন স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার ‘রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম’ বিল উত্থাপন করে সংসদে। বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক বাতাবরনে আচ্ছাদিত করার নতুন ষড়যন্ত্র। তৎকালীন সময়ের সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সমগ্র দেশে এই বিলের বিরোধীতা করে গড়ে ওঠে তীব্র ছাত্র আন্দোলন। যে ছাত্র আন্দেলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে রাজশাহীর প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ। জামিল আখতার রতন তখন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ শাখা ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি। স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অকুতভয় সৈনিক শহীদ জামিল আখতার রতন।
সারা দেশে এই আন্দোলন দমনের জন্য মাঠে নামে তৎকালিন স্বৈরশাসকের দোসর সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ইসলামী ছাত্র শিবীর। ৩০ তারিখ রাতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ আসে কলেজের বিভিন্ন হলে শিবীর এর বহিরাগত সন্ত্রাসীরা অস্ত্রসহ অবস্থান করছে। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৩১ মে সকালে ৩৫ জন শিক্ষকের টিমের সাথে জামিল আখতার রতন হল পরিদর্শনে আসলে খুনী শিবীর চক্র পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী উপস্থিত সকল শিক্ষক-ছাত্রের সামনে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে উল্লাস করতে করতে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে। সেদিন সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এই নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ’৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়। বাংলাদেশের শাসন পরিচালনায় নতুনভাবে যুক্ত হয় তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্র। কিন্তু শহীদ জামিল আখতার রতন সেদিন যে স্বপ্নকে, লক্ষ্যকে সামনে রেখে লড়াইয়ে যুক্ত করেছিলেন নিজেকে, সর্বপরি নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন, সেই স্বপ্ন আজো অধোরা হয়েই থেকে গেছে।
আমরা একটা বড় ভ্রমের মধ্যে ছিলাম। ব্যক্তি উচ্ছেদ হলেই যে তন্ত্র উচ্ছেদ হয়না সেটা সেদিন বোঝার ক্ষেত্রে ছিলো একটা মারাত্বক ভুল। আমাদের সমস্ত লড়াই সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিলো ব্যক্তি একজন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। আমরা সেদিন রাষ্ট্রের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে পারিনি। এরশাদ স্বৈরাচার পতনের ৩১ বছর পার হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় এই সময়ে কখনও বিএনপি’র নেতৃত্বে চার দলীয় জোট আর বাকি সময়ে সেই স্বৈরশাসক এর রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টিকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট।
বাংলাদেশের সংবিধানে ‘রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম’ প্রতিষ্ঠিত আছে। সেদিন শহীদ জামিলের সাথে যারা সংগ্রামে ছিলেন তাদের অনেকেই আজ ক্ষমতাসীন জোটের অংশিদার, যারা ইসালমকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে সংবিধানে যুক্ত করেছে। সেদিন এরশাদ যে স্বৈরাচারী কর্মকান্ড পরিচালনা করেছিলো, দিন যতো গেছে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিটি রাজনৈতিক দল যখন যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকেছে তারা পূর্বের যেকোন সময়ের চাইতে নিজেকে আরো অনেক বেশি স্বৈরশাসক হিসাবে প্রমাণ করেছে।
আমাদের আরেকটি মৌলিক ভুল ছিল, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা। ফলশ্রুতিতে লড়াইয়ের লক্ষ্যবস্তু থেকে দুরে সরে গেছি। এটা যে বিদ্যমান লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপজাত সেটা আমরা আজো সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছি। যার কারণে সংগ্রাম ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে। আমরা মনে করেছি, জামাতে ইসলাম-যুদ্ধপরাধীর বিচার, নিষিদ্ধ করলেই সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী রাজনীতির আর অস্তিত্ব থাকবে না। সেটা যে চরম ভ্রান্ত একটি বিষয় সেটি ইতিমধ্যে প্রমাণিত।
বিদ্যমান লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থার অস্তিত্ব যতদিন বিরাজমান থাকবে ততদিন এই ব্যবস্থার ছায়াতলে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী অপশক্তি পরগাছার মতো বাড়তে থাকবে। পরগাছা পোষক গাছের গায়ে লেগে থাকে এবং ওই গাছ থেকে পানি ও বেঁচে থাকার জন্য অন্যান্য পুষ্টি উপাদন সংগ্রহ করে। পোষক গাছ যতদিন বেঁচে থাকে পরগাছার আয়ু অনেকটাই নির্ভর করে তার উপর। সুতরাং এই ক্ষমতাতন্ত্র-লুটেরাতন্ত্র-গুন্ডাতন্ত্রকে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রাখে তাকে মোকাবেলা ব্যতীত সাম্প্রদায়িক,মৌলবাদী অপশক্তিকে উচ্ছেদ করা কখনওই সম্ভব নয়।
যখন যে ক্ষমতায় থেকেছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে তোয়াজ করে চলেছে। একের পর এক নির্বতনমূলক আইন তৈরি করা আর বিভিন্ন বাহিনী তৈরি করেছে। বিচার বর্হিভূত হত্যা সংঘটিত করেছে। ১০০ বছর আগের কলোনিয়াল আইন প্রয়োগ করে সাংবাদিক নির্যাতন করা হচ্ছে। অর্থাৎ একটি স্বাধীন দেশের শাসকগোষ্ঠী মননে-মানসে কলোনিয়াল শাসকের মতোই রয়ে গেছে। কেন এমটি ঘটেছে? কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
যারা বর্তমানে ক্ষমতায় আছে, অতীতের সকল রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে। বাক স্বাধীনতা থেকে শুরু করে মানুষ বেঁচে থাকবে, না মৃত্যুবরণ করবে সেটাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে। ‘গনতন্ত্র’র তকমা গায়ে লাগিয়ে রাখলেও নাগরিক তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। মৃত মানুষ কবর থেকে উঠে এসে ভোট দিয়ে যায়। অর্থাৎ যে নির্বাচনের মাধ্যমে তারা দেশের শাসক হিসাবে নিজেদের দাবী করে সেটিই প্রশ্নবিদ্ধ। এধরনের তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে। অনির্বাচিত স্বৈরশাসকের তুলনায় নির্বাচিত স্বৈরশাসক আরো অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়।
রাষ্ট্রের নাগরিকের মতামতকে আইনি, বেআইনি ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করা হচ্ছে। এভাবেই তার উপরে পূর্ণনিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে। সংসদকে কার্যত এক দলীয় সংসদে পরিণত করা হয়েছে। অলংকার হিসাবে একটি তথাকথিত বিরোধী দল আছে। যাদের দলীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তও ক্ষমতাসীনরা ঠিক করে দেয়। রাষ্ট্রে আমলা-নিরাপত্তা বাহিনীর প্রভাব তৈরি হয়েছে আকাশচুম্বী।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কার্যত স্যালাইন দিয়ে কোনরকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। কারণ প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ভঙ্গুর অবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সাংবাদিক রোজিনার জামিনের জন্য দফায় দফায় আইনমন্ত্রীর কাছে ছুটে যাওয়া হয়েছে, নানা নাটকীয়তার পর জামিন হলে তাঁর সতীর্থরা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রীকে!! ভেবে দেখুন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থায় জামিন হবে কী হবে না প্রধানমন্ত্রীর কী আদৌও কোন ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে, নেই। কিন্তু তারপরেও ধন্যবাদ কিন্তু পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী!
চলমান মহামারিকে কেন্দ্র করে অতীতের সকল গনবিরোধী কর্মকান্ডকে ছাপিয়ে গেছে। স্বাস্থ্যখাত আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। ২৫০ টাকার সুই কিনছে ২৫০০০ টাকায়! যতো বড় প্রজেক্ট তত বড় ডিল। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এরকম অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী অপশক্তি অন্য যেকোন ব্যবস্থার তুলনায় অধিকমাত্রায় পরিপুষ্ট হয়। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেটি দৃশ্যমান।
দেশে এখন দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, নারীবাদী আন্দোলন, মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন, পরিবেশবাদী আন্দোলন এধরনের আরো অনেক আন্দোলনই হচ্ছে কিন্তু তা সবগুলিই বিচ্ছিন্নভাবে।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বড় অংশ এনজিও, সিএসও আর অনলাইন এক্টিভিস্ট। আন্দোলন করছেন রাজনৈতিক বিষয়ে কিন্তু রাজনৈতিক দল সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ। ফেসবুকের প্রোফাইলে আবার লিখে রাখেন ‘আই হেট পলিটিক্স’। তারা কর্মসূচি পালন করে দাবী তোলেন, কিন্তু দাবী বাস্তবায়নের পথ সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারন করেন না। তাদের এই ভূমিকা বর্তমান এই লুটেরা ব্যবস্থাপনাকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে।
এ ধরনের আন্দোলন জারি থাকলে জনগণের ক্ষোভ প্রশমিত করতে সহায়তা করে। অনেকটা বিভিন্ন চ্যানেলের টকশো’র মতো। মানুষ তার মনের সব ক্ষোভ-বিক্ষোভ নিয়ে টিভি’র সামনে বসে আলোচকের গরম গরম কথা শোনেন, মনে করেন এই কথাগুলি যেনো তিনিই বলছেন, এতে তার মনের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত হয়ে আসে। তিনি সুন্দর একটা ঘুম দেন, সারা দিনে নানা ক্ষোভ জমা হয়, রাতে আবার প্রশমিত হয়ে আসে। অর্থাৎ তার ক্ষোভ যাতে চুড়ান্তভাবে বিস্ফোরিত না হয় এটা তারই একটা ঔসধ। এটাও শাসকগোষ্ঠীর জ্ঞাত কৌশল।
আর আমরা এইসব কৌশলে বন্দি হয়ে আছি। এজন্যই শহীদ জামিলের স্বপ্ন ৩৩ বছর পর আজো স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেছে। আমাদের লড়াইকে অগ্রসর করতে হবে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, লড়াই করতে হবে তন্ত্রের বিরুদ্ধে। তবেই শহীদ জামিল আখতার রতনসহ অসংখ্য শহীদের লালিত স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।