তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও পানির লবণাক্ততার তারতম্য : এক দশকে চিংড়ি উৎপাদন কমেছে

0
206

শেখ তৌফিকুর রহমান

খুলনার পাইকগাছা এলাকার সোলাদানা ইউনিয়নের ১০৬ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করেন ফয়সাল মাহমুদ অপু। কয়েক বছর ধরেই তিনি লক্ষ করছেন, তার চিংড়ি ঘেরে উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কমছে। একই অবস্থা আশপাশের অন্য চিংড়িচাষীদেরও। কারণ হিসেবে ফয়সাল মনে করেন, শিবসা নদীর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে স্থানীয় ঘেরগুলোতে পানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। নিয়মিত পানি সরবরাহ করতে না পারলে ঘেরের পানির গুণগত মান ঠিক থাকে না। এতে চিংড়ি সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে দুর্বল মাছগুলো মরে যায়। এ কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চিংড়ি উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত চিংড়ি শিল্পে। প্রতি বছরই কমছে চিংড়ি উৎপাদন। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে চিংড়ি উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৩৯ হাজার ৮৫৫ টন। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৪৭ হাজার ৩০৪ টন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে চিংড়ি উৎপাদন কমেছে ৭ হাজার ৪৪৯ টন। গত এক দশকে সর্বোচ্চ চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ২০১১-১২ অর্থবছরে, যার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫২ হাজার ৫২৩ টন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পানির লবণাক্ততার তারতম্য, চিংড়ি ঘেরের গভীরতা হ্রাস, মানসম্মত পোনার অভাব, পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের অপর্যাপ্ততা, মাটি ও পানির শক্তি হ্রাসের কারণে চিংড়ি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করার প্রত্যেকটি নিয়ামক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সঙ্গে জড়িত।
দেশের চিংড়ি উৎপাদনের উর্বরভূমি হিসেবে চারটি জেলাকে বিবেচনা করা হয়। সেগুলো খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও কক্সবাজার। এ জেলাগুলোতে চাষীরা রফতানিযোগ্য বাগদা ও গলদা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করেন। তবে গলদা ও বাগদা চিংড়ির চাষ পদ্ধতির ভিন্নতা রয়েছে। গলদা স্বাদু পানির মাছ হলেও কম লবণাক্ত পানিতেও চাষ করা যায়। তবে বাগদা চিংড়ি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন লবণাক্ত পানি।
কথা হয় বাগেরহাট ও পাইকগাছার বেশ কয়েকজন ঘের মালিকের সঙ্গে। তারা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত কয়েক বছরে দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ নদীর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। ফলে চিংড়ি ঘেরগুলোতে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়া তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টির কারণে ঘেরের পানির লবণাক্ততার তারতম্য ঘটছে। এছাড়া হঠাৎ অতিরিক্ত গরম ও ঠা-ার কারণে চিংড়িগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। এতে কখনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দেখা দিলে চিংড়িগুলো সহজেই আক্রান্ত হয়। অনেক সময় এ মড়ক এক ঘের থেকে অন্য ঘেরে ছড়িয়ে পড়ে। মালিকরা জানান, এখন ভালো মানের পোনাও পাওয়া যায় না। কারণ পোনার প্রধান উৎস নদী। পানিপ্রবাহের মাত্রা কমে যাওয়ায় নদী থেকে যথাযথ পরিমাণে পোনা আহরণ করা যায় না। এছাড়া হ্যাচারি থেকে যেসব পোনা পাওয়া যায়, তার গুণগত মান সবসময় এক রকম থাকে না।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতায় পাইকগাছায় স্থাপন করা হয়েছে লোনা পানি কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটিতে কৃত্রিম উপায়ে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষের উন্নততর কলাকৌশল উদ্ভাবন, চিংড়িচাষীদের আর্থসামাজিক অবস্থা, বাগদা চিংড়ির প্রাকৃতিক উৎস নিরূপণ এবং উপকূলীয় পরিবেশসহ চিংড়ির পোনা সংগ্রহকালে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়াসহ নানাবিধ বিষয়ে গবেষণা হয়।
চিংড়ি উৎপাদন কমার কারণ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. লতিফুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চিংড়ি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদী ভরাট হয়েছে। নদীর যে স্রোত ছিল, সেটা কমেছে। এতে পানির লবণাক্ততার পরিমাণে উত্থান-পতন হয়েছে। এছাড়া খরা বা অসময়ে বৃষ্টি কিংবা অতিবৃষ্টি এগুলো চিংড়িসহ যেকোনো ফসলের জন্য ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, এ এলাকার ঘেরগুলোর পানির গভীরতা কমে গেছে। পলির স্তর পড়ে যাওয়ার কারণে অনেক ঘেরে মাত্র এক-দুই হাত বা এক ফুট উচ্চতার পানি থাকে। এতে চৈত্র মাসে পানির নিচের মাটি পর্যন্ত গরম হয়ে যায়। এতে চিংড়ি দুর্বল হয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এভাবে ধীরে ধীরে রোগাক্রান্ত হতে হতে ঘেরে মড়ক লাগে। এছাড়া নদীর দূষণ একটি বড় বিষয়। নদীর পানির মাধ্যমে দূষিত পদার্থ চিংড়ি ঘেরে ঢুকে যাচ্ছে। এতেও চিংড়ির ক্ষতি হচ্ছে।
লোনা পানি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরো বলেন, কেবল এককভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যাবে না। চিংড়ি উৎপাদন কমার আরো কিছু কারণ আছে। যেমন- আমাদের দেশে চিংড়ি চাষ পদ্ধতির উন্নতি হয়নি। দেশে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে বেশ লম্বা সময় ধরে। প্রায় ৫০-৬০ বছর ধরে আমরা চিংড়ি চাষ করছি। কিন্তু এখনো বিজ্ঞানভিত্তিক চাষের দিকে না এগিয়ে আমরা সনাতন পদ্ধতিকে বেছে নিচ্ছি। স্বল্প সময়ের গবেষণা দিয়ে পুরো বিষয়টি বোঝা যাবে না। এজন্য দীর্ঘ গবেষণার প্রয়োজন।
আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাগেরহাটে গড়ে উঠেছে চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্র। চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি, রোগ নির্ণয় ও প্রতিকার এবং চিংড়িজাত পণ্যের গুণগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে যাচ্ছে। চিংড়ি উৎপাদন হ্রাসের কারণ সম্পর্কে কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিলুফা বেগম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েছে। আমাদের দেশেও ঋতু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। এতে মাছের ঘেরের পানি অতিরিক্ত গরম হচ্ছে। পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ও প্রচ- গরমে চিংড়ি লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না। আবার কখনো রাতে হঠাৎ বৃষ্টির কারণে বা হঠাৎ ঠা-ার কারণেও চিংড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে।
তিনি জানান, চিংড়ি কিন্তু একদিনে রোগাক্রান্ত হয় না। বিভিন্ন ফ্যাক্টর রয়েছে। যেমন তাপমাত্রা, স্যালাইন ডিফল্ট করা, মাটির পিএইচ, অক্সিজেন ইত্যাদি, যার কারণে উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী শামস্ আফরোজ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চিংড়ি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে এটা সত্য। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পানি শুকিয়ে যাওয়া, ঘেরের নাব্যতা কমার মতো ঘটনা ঘটে। এতে চিংড়ি উৎপাদন কমে যেতে পারে। তবে উৎপাদন কমার আরো কিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে চিংড়ি চাষের জমি কমে যাওয়া, চাষীদের অনেকেরই চিংড়ি চাষের পরিবর্তে কাঁকড়া বা অনান্য ফসল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে যাওয়া; এসব কারণেও উৎপাদন তুলনামূলক কমেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here