আবু নাসের অনিক
৩ মে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’। ১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে তারিখটিকে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অর্জন, অবস্থান কী?
স্বাধীন হওয়ার ২ বছরের মাথায় ১৯৭৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন,১৯৭৪’ জারি করা হয়। এই আইনে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সরকারিভাবে প্রকাশিত ৪ টি পত্রিকা ব্যতীত অন্যসব পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশে এভাবেই মুক্ত গণমাধ্যমের যাত্রা শুরু!
অর্থাৎ জন্মের সূচনা লগ্নেই ‘মুক্ত গণমাধ্যম’ কনসেপ্ট হোঁচট খায়। একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার সাথে মুক্ত গণমাধ্যম কোনভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কেবলমাত্র একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেই মুক্ত গণমাধ্যম চর্চার ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। তারপরেও সেখানে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ থাকে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাটাই এখনো অধরা!
প্যারিস ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডারস গত ২০ এপ্রিল, ২০২১ তাদের ২০২০ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি বলছে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান (ভালো থেকে খারাপ) ১৫২তম। দ:এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিচে। ২০০৯ সালে এই অবস্থান ছিলো ১২১। অর্থাৎ গত ১২ বছরে সূচকে পিছিয়েছে ৩১ ধাপ (আরএসএফ)।
তথ্যমন্ত্রী উচ্চকন্ঠে এই তথ্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। অবশ্য ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিলো না তখন ঐ বছরের প্রকাশিত রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলো, দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নাই, নির্বাচিত হলে স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। যখন যারা ক্ষমতায় থাকে তারা এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে আর বিরোধীরা স্বাগত জানায়। স্বাধীনতা কতটা নিশ্চিত হয়েছে বিবেচনা করুন!!
মুক্ত গণমাধ্যম বলতে যা বোঝায় বিশ্বব্যাপী তা হুমকির মুখে। বাংলাদেশে অবস্থা আরো বেশি নাজুক। লুটেরা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মুক্ত গণমাধ্যমের চিন্তা করাটা অনেকটা ‘অলীক স্বপ্ন’। বিগত ৫০ বছরের শাসনামলে কোন সরকারই গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালন করতে দেয়নি। তবে গণমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের একটা অংশ স্বাধীনভাবে ভূমিকা পালনের জন্য পূর্বেও তাদের লড়াই জারি রেখেছিলো এখনও জারি রেখেছে। বর্তমান সময়ে এসে এই লড়াইয়ের ধারাটি অনেক বেশি ক্ষয়িঞ্চু হয়ে গেছে।
অবশ্য এটা খুবই ন্যায্য আলোচনা যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কী শুধুমাত্র শাসকগোষ্ঠী বা সরকারই বাধাগ্রস্ত করে, নাকি অন্য কিছু দ্বারাও বাধাগ্রস্ত হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে বলা যায়, শুধুমাত্র সরকার নয়, অন্য আরো অনেক প্রভাবক শক্তি গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। একজন সংবাদকর্মীর স্বাধীন ভূমিকা নেওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
নব্বই দশকের শুরুতেই দেশের লুটেরা ধনীক শ্রেণী তাদের লুটপাটের কর্মকান্ডকে আড়াঁল করার অস্ত্র হিসাবে মিডিয়া হাউজ গড়ে তোলে। রাতারাতি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের মালিক বনে যায়। গণমাধ্যমের মালিকানায় তথাকথিত কর্পোরেট পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটে। এ সমস্ত গণমাধ্যম ব্যবহার করে তারা দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতিতে তাদের নিরঙ্কুশ প্রভাব বিস্তার করে।
সংবাদকর্মীর স্বাধীনতা, মুক্ত গণমাধ্যমের নামে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের মালিকানাধীন গণমাধ্যমকে ইচ্ছামতো ব্যবহারের স্বাধীনতা চর্চা শুরু হয়। করেনাকালে যেমন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কংকালসার দেহের প্রকাশ ঘটেছে, একই রকম ভাবে সাম্প্রতিক সময়ে ‘মুনিয়া’র মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে এখানকার অধিকাংশ তথাকথিত গণমাধ্যমের দুর্গন্ধময় চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
মুক্ত গণমাধ্যম চর্চায় সরকারের সাথে সাথে এরাও একটি বড় বাধা। অধিকাংশ গণমাধ্যম এই সমস্ত লুটেরা তথাকথিত কর্পোরেট হাউজের বাণিজ্যিক প্রচার মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে এই মিডিয়া হাউজগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। গণমাধ্যমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই এরা পরিবর্তন করে ফেলেছে।
গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমে বস্তু-ন্যায়নিষ্ঠ, নিরেপেক্ষভাবে সংবাদ প্রকাশিত হয়। আর বাণিজ্যিক প্রচার মাধ্যমে নিজস্ব এজেন্ডা হিসাবে নানামূখী কনটেন্ট তৈরি করে সেগুলি প্রচার করে জনমতকে প্রভাবিত করা হয়। দেশে যে সমস্ত প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন গণমাধ্যম রয়েছে, এর মধ্যে একটি বড় অংশ কার্যত বাণিজ্যিক প্রচার মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। লুটপাটকারীর কালো টাকা বিনিয়োগ ও রক্ষার অন্যতম ক্ষেত্র এই মিডিয়া হাউজগুলি।
এ সমস্ত প্রচার মাধ্যমে উচ্চপদ (সম্পাদক) থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের কর্মী এরা সকলেই অন্য আর দশটা চাকরীর মতো চাকরী করে। সংবাদকর্মী হিসাবে নয়। মালিকের নির্দেশনা অনুসারে এ্যাক্ট-রিএ্যাক্ট করাই এদের কাজ। মালিকের রাজনৈতিক দর্শনই এদের দর্শন হয়ে যায়। হতে বাধ্য হয়। প্রশ্নটি রুটি-রুজির সাথে সম্পর্কিত, দর্শনের সাথে নয়।
আমার অনেক ফেসবুক বন্ধু গত দুই দিন পোস্ট দিচ্ছেন,‘আমি কালের কন্ঠের সাংবাদিক, আমি গর্বিত’। আমি তাদের অনেককেই ব্যক্তিগতভাবে চিনি। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে চাকরী বাঁচানোর জন্যই শুধুমাত্র মালিকের নির্দেশে এই স্টাটাস দেওয়া। এর সাথে না আছে দর্শনের, না আছে পছন্দ-অপছন্দের কোন সম্পর্ক!!
সমস্যা হচ্ছে, সমাজে একজন সংবাদকর্মীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার ভিন্ন একটি চিত্র আছে। দেশের অনেক অগ্রজ সংবাদকর্মী এ ধরনের ইমেজ প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সংবাদকর্মী অন্যায়ের সাথে আপোস করবে না, সত্য-ন্যায়ের পক্ষে থাকবে, নিরেপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে।
যেহেতু গণমাধ্যম আর বাণিজ্যিক প্রচার মাধ্যম একাকার হয়ে গেছে, তার কারণে প্রচার মাধ্যমে যারা চাকুরী করে জীবন নির্বাহ করে তাদের কাছে আদর্শ সংবাদকর্মীর বৈশিষ্ট্য কাঙ্খিত হয়! কিন্তু এটা যখন পূরণ হয় না তখন যারা সত্যিকার অর্থেই সংবাদকর্মী তাদের সবার উপরেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
কর্পোরেট হাউজগুলো তাদের মালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রচার মাধ্যমগুলিকে গণমাধ্যমের লেবাস পরিয়ে রেখেছে। যাতে একদিকে প্রচার অন্যদিকে দর কষাকষিতেও সুবিধা করা যায়। এই প্রচার মাধ্যমগুলিই সমাজে সামাজিক সম্মতি উৎপাদন করে। কোনটির পর কোনটি প্রচারে এনে পরিস্থিতি কোন দিকে নিতে হবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করে।
রাজনীতির গতিমুখ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। লুটেরা এ সমস্ত কর্পোরেট হাউসগুলো তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠীর যে অংশ সহায়তা করতে প্রস্তুত তার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। এ কারণেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে আসবে না আসবে সেটা নির্ধারণেও ভূমিকা রাখে। তাদের মালিকানাধীন তথাকথিত গণমাধ্যম ব্যবহার করে তার পক্ষে জন সম্মতি গড়ে তোলে।
রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা থাকে, কিংবা দেশের অর্থনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করে, নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তাদেরকে প্রতিনিয়ত জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করতে হয়। ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট বইয়ে চমস্কি এবং হারম্যান বলেন,‘গণমাধ্যমের কাজ হচ্ছে নিরবিচ্ছিন্ন প্রচারণা চালিয়ে নাগরিকদের বিভ্রান্ত করে তাদের কাছ থেকে রাষ্ট্রের গণস্বার্থবিরোধী কর্মকান্ডের পক্ষে সম্মতি আদায় করে নেওয়া’। এক্ষেত্রে তাঁরা বলেছেন যেকোন সংবাদকে ধাপে ধাপে পাঁচটি ফিল্টারের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তারা এটির নামকরণ করেছেন ‘প্রপাগান্ডা মডেল’।
মডেলের প্রথম ফিল্টারটি হলো গণমাধ্যমের মালিকানা। এই মালিকানা অনুযায়ী, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থবিরোধী কোন সংবাদ প্রকাশিত হবে না। এবং এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা যেহেতু তাদের বিভিন্ন ব্যবসার জন্য সরকারের উপর নির্ভরশীল, সেকারণে নিজেদের স্বার্থেই তারা সরকারের সমালোচনার ব্যাপারেও সাবধানী থাকবে। অন্য চারটি ফিল্টারের মধ্যে আছে বিজ্ঞাপন, সংবাদ উৎসের সীমাবদ্ধতা, সমালোচনা ও জাতীয় শত্রু।
সরকারের পক্ষ থেকে সে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে তেমনটি নয়। লুটেরা শাসকগোষ্ঠী ও পুঁজিপতিদের অবাধ লুটপাটকে বাধাহীন করার ক্ষেত্রে মুক্ত গণমাধ্যম একটি বড় বাধা। সেজন্যই ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করলেও, করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এই আইনের ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১- ধারার মাধ্যম মুক্ত গণমাধ্যমকে পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে।
গত বছর আর এ বছরের প্রথম চার মাস মিলিয়ে সংবাদকর্মীদের নামে মামলা হয়েছে ৪৬ টি। আসামী করা হয়েছে ৮২ জনকে। গ্রেপ্তার হয়েছে ৩২ জন। মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা। যাতে নিজেই নিজের উপর অটো সেন্সরশীপ আরোপ করে। প্রতিটা মামলার বাদী ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত, হয় রাজনৈতিক নয়তো সরকারী।
এইতো আমাদের মুক্ত গণমাধ্যমের চালচিত্র! একদিকে লুটেরা শাসকগোষ্ঠী অন্যদিকে লুটেরা মালিকগোষ্ঠী। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চিড়েচেপ্টা অবস্থা। কিছুটা ‘শাঁখের করাত’ এর মতো। এদিক গেলেও কাটে ওদিক গেলেও কাটে। লুটেরা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় গণমাধ্যম লুটেরাদের পক্ষেই ভূমিকা নেয়। লুটেরাদের পক্ষেই সামাজিক সম্মতি উৎপাদন করে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ব্যতীত মুক্ত গণমাধ্যম শুধুই ‘মরিচীকা’।