করোনাকালে জীবিকার চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি

0
173

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
গত বছর বাংলাদেশে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে যে বিষয়টি সবসময় আলোচিত হয়ে আসছে সেটি হলো- জীবন না জীবিকা- কোনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মুহূর্তে? উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নতসহ সব দেশেই এ বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। আমাদের দেশে সরকার মানুষের জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। এমতাবস্থায় বিরোধী রাজনীতিবিদরা বরাবরই সরকারের সব সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন। তাদের মতে সরকারকে একদিকে যেমন জনগণের জীবন বাঁচাতে হবে, অন্যদিকে জনগণের জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ধরনের যুক্তি কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতিতে মানুষকে ঘরে বসিয়ে রেখে মাসের পর মাস সহায়তা দেওয়া সম্ভব নয়। অতএব করোনা মহামারি মোকাবিলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে খুবই কঠিন।
কভিড-১৯ মহামারির প্রথম ঢেউ আমরা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি। মহামারির প্রথম দিকে সরকার লকডাউনের পরিবর্তে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পরে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিলেন। আবার সাধারণ ছুটি চলাকালীন কলকারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটিও বেশ সমালোচিত হয়েছিল। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, এই ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে সংক্রমণ অত্যন্ত ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। কিন্তু সরকারের সেই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছিল। যার কারণে আমরা করোনার প্রথম ঢেউকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
কভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ যখন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাপক তা-ব চালাচ্ছে ঠিক সেই সময় আবার যে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তা হলো আমরা জীবন রক্ষা করব, না জীবিকার জন্য সবকিছু উন্মুক্ত করে দেব। সরকার গত তিন সপ্তাহ ধরে লকডাউন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। যদি আমরা জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপট থেকে বিষয়টিকে বিচার করি তাহলে করোনা মহামারি মোকাবিলায় পূর্ণাঙ্গ লকডাউন ছাড়া আর কোনো বিকল্প হতে পারে না। পাশাপাশি এটাও ভাবতে হবে যে পূর্ণাঙ্গ লকডাউন কতটা সময় ধরে বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। এই কারণেই হয়তো সরকার মাঝে মধ্যে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিলেও পরবর্তী সময়ে দোকানপাটসহ শপিংমলগুলো স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে খুলে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, লকডাউনের কঠোর বাস্তবায়ন সত্যিই করোনা মহামারি মোকাবিলার একটি অন্যতম হাতিয়ার, যার সুফল আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। গত তিন সপ্তাহ লকডাউন বাস্তবায়নের ফলে সংক্রমণের হার ২৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। মনে রাখতে হবে, এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব বাংলাদেশে দেখতে পাওয়া গেছে, যা প্রথম ঢেউয়ের ভাইরাসের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের শারীরিক সুরক্ষা ভেদ করে একজন রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে আমাদের কোনো সেক্টরেই সুরক্ষা বিধি মানার ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে অনীহা বা শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নেই। সুরক্ষা বিধি মানার ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে যে আহ্বান জানানো হয়েছে তা পুরোপুরি মেনে না চললে আমাদের জন্য ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।
ইতোমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বলেছেন, মানুষের জীবন রক্ষা করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব। কারণ জীবিকার জন্য জীবন নয়, বরং জীবনের জন্য জীবিকা। আমাদের জীবনই যদি না থাকে তাহলে জীবিকা দিয়ে কি হবে? ফলে এই মুহূর্তে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেদের সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা। আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি, সরকার লকডাউনের মেয়াদ আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই লকডাউনের জন্য দেশের বিশাল সংখ্যার জনগোষ্ঠী, যারা দিন আনে দিন খায় তারা দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে। এক্ষেত্রে দরকার পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
করোনার প্রথম ঢেউয়ে বাংলাদেশের মতোই ভারত খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ফলে, খুব অল্পসময়ের মধ্যেই করোনার প্রথম ঢেউ উত্তরণ ঘটিয়ে সেখানে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল। ভারত সরকার সব কিছুই খুলে দিয়েছিল অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য। একইসঙ্গে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও, বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মসূচি উদযাপনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল সেখানে। ফলে, জনগণের অবাধ চলাফেরা ও সুরক্ষা বিধি মানতে অনীহার কারণে ভারতে করোনা মহামারি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে। ভারত নিজেদের রেকর্ড ভেঙে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড করছে প্রতিদিন। ভারতজুড়ে অপিজেনের অভাবে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। রোগীদের আত্মীয়স্বজনের আহাজারিতে চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে যাছে। মৃত ব্যক্তিদের সৎকাজ করার পর্যাপ্ত জায়গা ও সুযোগ নেই।
এমতাবস্থায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভারতের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের উচিত ভারতের থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। ইতোমধ্যেই আমরা ভারতে করোনার ট্রিপল মিউট্যান্টের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পেরেছি, যা আগের স্ট্রেইনগুলোর তুলনায় ৩০০ শতাংশ অধিক হারে আক্রান্ত করতে পারে। এই স্ট্রেইনগুলো এতটাই শক্তিশালী যে মানুষের শরীরের সুরক্ষা ব্যবস্থাকে অতি সহজেই ভেদ করে রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনকি টিকা নিলেও এই স্ট্রেইনগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। এই ট্রিপল মিউট্যান্টের ভাইরাস যদি আমাদের দেশে ঢুকে পড়ে তাহলে সার্বিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেই সরকার দুই সপ্তাহের জন্য ভারতের সঙ্গে সব বর্ডার বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত সঠিক বলে মনে করি। আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছি দেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউসহ সাধারণ বেডের অপ্রতুলতা। অপিজেন সরবরাহের ঘাটতি ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা গেছে। ভারত অপিজেন সরবরাহ একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করার আগে আমাদের সকলকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, গত এক সপ্তাহে অনেকেই ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেন। আমরা এমনও জানতে পেরেছি যে, ভারত থেকে আসার পর অনেকের শরীরে করোনার সংক্রমণ দেখা গেছে। যদিও সরকার ভারত থেকে যারা বাংলাদেশে এসেছেন তাদের প্রত্যেকের জন্য ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করেছে, কিন্তু এই সিদ্ধান্তের কঠোর প্রয়োগ যদি না করতে পারি এবং ট্রিপল মিউট্যান্টের ভাইরাস বহনকারী কোনো ব্যক্তি যদি অন্য মানুষদের সংস্পর্শে আসে তাহলে সেটি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাজের অন্যদের সংক্রমিত করবে। সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ভারত থেকে আসা দশজন করোনা রোগী যশোর হসপিটাল থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন বার বার ঘুরেফিরে আসে, আর সেটি হলো এই ধরনের মহামারির সময় জনগণের কি কোন ধরনের দায়বদ্ধতা নেই?
জনগণ যদি নিজেদের পরিবারের সদস্যদের ও সার্বিকভাবে দেশ ও জাতির জন্য কোনো চিন্তা-ভাবনা করত তাহলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। কারণ, এই পরিস্থিতির জন্য যতটা না দায় সরকারের তার চেয়ে অনেক বেশি দায় জনগণের। কারণ, সুরক্ষা বিধি মানার ক্ষেত্রে বিশাল অংশের জনগণের মধ্যে শৈথিল্য সবসময়ই ছিল।
সরকারের একক প্রচেষ্টায় মহামারি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এ অবস্থায় আমাদের সকলকে (বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তি পর্যায় ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে) এগিয়ে আসতে হবে, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজেদের অবস্থান থেকে একজন মানুষকেও সহায়তা করি তাহলে এই ধরনের মহামারি মোকাবিলা করা সহজ হবে। আমরা জানি, মানুষ মানুষের জন্য। এটাও মনে রাখতে হবে, জীবনের জন্য জীবিকা, জীবিকার জন্য জীবন নয়। আসুন ভারতের অবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বর্তমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করি। সকলে মিলে এই প্রার্থনা করি, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র যেন অল্পসময়ের মধ্যে করোনা মহামারির ভয়াবহতা অতিক্রম করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনের বিভাগের অধ্যাপক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here