আন্তর্জাতিক ডেস্ক
কভিড-১৯ সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতি দিল্লির স্বাস্থ্য খাতে মারাত্মক চাপ ফেলে দিয়েছে। স্বাস্থ্য সরঞ্জামের অপ্রতুল সরবরাহকে সম্বল করেই হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্থানীয় ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। নিজেদের সুরক্ষার চিন্তা ভুলে গিয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে রীতিমতো যুদ্ধ করে যাচ্ছেন তারা।
একই সময় আরেক লড়াই চলছে দিল্লির শ্মশান ও কবরস্থানগুলোয়। যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে এসব শ্মশান ও কবরস্থানে জায়গার সংকুলান হচ্ছে না, বিশেষ করে শ্মশানগুলোয়। সেখানে এখন একসঙ্গে অনেকগুলো চিতা জ্বালিয়েও স্থান সংকুলান করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ শ্মশানেরই জায়গা অস্থায়ীভাবে বাড়িয়ে নিতে হচ্ছে। এছাড়া পার্কিং লটসহ বিভিন্ন খালি স্থানকেও এখন কাজে লাগানো হচ্ছে মরদেহ সত্কারে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করেও মরদেহের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছেন না শ্মশানকর্মীরা। অন্যদিকে মরদেহ সত্কারের সুযোগ পেতে মৃতের পরিবারকেও অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
ভারতে এখন করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় প্রবাহ চলছে। এ মুহূর্তে কভিড-১৯-এর বৈশ্বিক সংক্রমণের ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত। গতকাল সকালে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলছে, এর আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার ২৫৭ জন। অন্যদিকে এ ২৪ ঘণ্টায় দেশটিতে মৃত্যু হয়েছে রেকর্ড ৩ হাজার ৬৪৫ জনের। এর মধ্যে শুধু রাজধানী দিল্লিতেই শনাক্ত হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার।
ভারতের রাজধানী শহরের সরাই কালে খাঁ শ্মশানে ২৭টি নতুন চিতাদাহের স্থান তৈরি করেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। সংলগ্ন একটি পার্কে তৈরি করা হচ্ছে আরো ডজনখানেক। এছাড়া নগরীতে যমুনা তীরবর্তী স্থানে আরো জায়গা খোঁজা হচ্ছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, শ্মশানটির প্রকৃত সক্ষমতা ছিল একসঙ্গে ২২ জনের মরদেহ দাহ করার। বর্তমান পরিস্থিতিতে সক্ষমতা অনেক বাড়িয়েও হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্মীদের। বর্তমানে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত একটানা কাজ করেও তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।
অন্যদিকে পূর্ব দিল্লির গাজীপুর শ্মশানেরও অস্থায়ী সম্প্রসারণে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। এক কার পার্কিংয়ে যোগ করতে হয়েছে ২০টি নতুন চিতাশয্যার স্থান।
নগরীটিতে এখন চিতা জ্বালানোর পর্যাপ্ত কাঠও পাওয়া যাচ্ছে না। চিতায় ব্যবহারের জন্য নগরীর পার্কগুলো থেকেও গাছ কেটে ফেলতে হচ্ছে। অন্যদিকে শ্মশানে আগত মৃতদের আত্মীয়-স্বজনদেরও বলা হচ্ছে কাঠ জড়ো করাসহ শেষকৃতের অন্যান্য ক্রিয়াকর্মে সহযোগিতা করতে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দিল্লিতে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৩৬৮ জনের। এরপর আরো ৩৮১ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, প্রকৃতপক্ষে মৃতের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ হাসপাতালের ফটক, অ্যাম্বুলেন্স বা বাড়িতে মৃত ব্যক্তিদের এ সংখ্যায় যোগ করা হচ্ছে না।
আনুষ্ঠানিক তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দিল্লিতেই মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি মানুষের। কিন্তু এ তথ্যকে অর্থহীন দাবি করে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ভাষ্য, অন্তত আরো কয়েকশ মানুষের তথ্য এতে যোগ করা হয়নি।
দিল্লিতে নতুন রোগীর চাপ এখন ভয়াবহ। অনেক নতুন রোগীই এখন হাসপাতালে ঢোকারই সুযোগ পাচ্ছেন না। তাদের অনেকেই করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। অনেকে তাদের পরীক্ষার ফল হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। আবার কেউ কেউ কভিড নেগেটিভ হিসেবে চিহ্নিত হলেও তাদের বুকে সিটি স্ক্যানের তথ্যে স্পষ্ট সংক্রমণের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে করোনায় মৃত মুসলিম বা খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় নিয়ম মেনে দাফনেরও সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে পূর্ব দিল্লির এক ৬৯ বছর বয়সী বাসিন্দার কথা। তার ছেলে তাকে অনেকগুলো হাসপাতালে চেষ্টার পরও ভর্তি করাতে পারেননি। অনেকটা চিকিৎসার অভাবেই মৃত্যু হয় তার। শেষ পর্যন্ত তাকে বাড়ির নিকটবর্তী একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়, যেখানে কেউ তার ডেথ সার্টিফিকেটও চায়নি।
এ চিত্র এখন শুধু দিল্লিতে সীমাবদ্ধ নেই। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলেই এখন কম-বেশি এ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও তথৈবচ। বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় প্রকাশিত রাজ্য সরকারের তথ্য অনুযায়ী, এর আগের ২৪ ঘণ্টায় এখানে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১৭ হাজার ৪০৩ জনের। মৃত্যু হয়েছে রেকর্ড সর্বোচ্চ ৮৯ জনের।