সত্যপাঠ ডেস্ক
নতুন আবাসিক গ্যাস সংযোগের আবেদন করে ডিমান্ড নোটের (অগ্রিম) টাকা জমা দিয়েছিলেন রাজধানীর অর্ধলক্ষাধিক গ্রাহক। কিন্তু নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় এসব টাকা পড়ে আছে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির কাছে। গত বছরের ডিসেম্বরে এ সম্পর্কিত একটি নির্দেশনা জারি করে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে তিতাসকে আদেশ দেয় জ্বালানি বিভাগ।
কিন্তু এ আদেশের চার মাস পেরিয়ে গেলেও আবেদনকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারেনি সংস্থাটি। তারা বলছে, নতুন সংযোগের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত বদলালে এসব গ্রাহক গ্যাস সংযোগ পেতে পারেন। সে কারণেই টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী ইকবাল মোহাম্মাদ নুরুল্লাহ বলেন, ডিমান্ড নোটের টাকা নিয়ে আসলে আমরা ইচ্ছা করেই চুপ করে আছি। কারণ গ্যাস নিয়ে যদি কখনো সরকার সিদ্ধান্ত বদলায়, তাহলে এ গ্রাহকরা একটা সুযোগ পাবেন। অনেক সময় দেখা যায় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে গ্রাহকদের জন্য এ ধরনের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে আবেদনকারীরা একটা সুযোগ পেয়েও যেতে পারেন। সে কারণেই এখনো টাকা ফেরত দেয়া হয়নি।
তিনি বলেন, ডিমান্ড নোট নিয়ে জ্বালানি বিভাগ আমাদের আদেশ দিয়েছে। মূলত আদেশে দুটি বিষয় ছিল। আমরা প্রথমটি বাস্তবায়ন করেছি। দ্বিতীয়টি গ্রাহকদের কথা বিবেচনা করে জ্বালানি বিভাগের পরবর্তী সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।
অবশ্য তিতাস কিছুটা অপেক্ষা করতে চাইলেও জ্বালানি বিভাগ বলছে, গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতেই হবে। নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
মূলত ২০১৯ সালের ২১ মে গ্যাস সংযোগ বন্ধ নিয়ে এক আদেশ জারি করে সরকার। সেই আদেশে আবাসিক, সিএনজি ও বাণিজ্যিক স্থাপনায় নতুন গ্যাস সংযোগ না দিতে নির্দেশনা জারি করা হয়। ওই সময়ের আগে যারা ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দিয়েছিলেন, তাদের টাকা ফেরত দিতে নির্দেশনা দেয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
তিতাসের একটি সূত্র জানিয়েছে, নতুন গ্যাস সংযোগের জন্য সংস্থাটির কাছে ৫৬ থেকে ৫৮ হাজারের মতো গ্রাহকের ডিমান্ড নোটের টাকা জমা রয়েছে। দূরত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ডিমান্ড নোটের টাকার পরিমাণ নির্ভর করে। সূত্রটি বলছে, গ্রাহকপ্রতি গড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত জমা রয়েছে। সব মিলিয়ে এ অর্থের পরিমাণ প্রায় ৪০ কোটি টাকা।
এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ডিসেম্বরে জ্বালানি বিভাগ এক আদেশে তিতাসকে দুটি বিষয়ে নির্দেশনা দেয়। প্রথমটি হলো, যারা ডিমান্ড নোট পেয়ে টাকা জমা দেয়নি, তাদের আবেদন বাতিল করা। দ্বিতীয়ত, যারা টাকা জমা দিয়েছেন, দ্রুত পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাদের সে টাকা ফেরত দেয়া। প্রথমটি বাস্তবায়ন করলেও দ্বিতীয় নির্দেশনা এখনো বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেনি তিতাস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাসের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দ্বিতীয় আদেশটি বাস্তবায়নে একটি বৈঠক হয়েছিল। সেখানে অনলাইনের মাধ্যমে কোনো বিকল্প উপায় ব্যবহার করে গ্রাহককে তার টাকা ফেরত দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু পরে আর সেটিতে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে জ্বালানি বিভাগ নতুন আর কোনো নির্দেশনা দেয় কিনা, সেদিকে তিতাস তাকিয়ে আছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিসুর রহমান বলেন, ডিমান্ড নোটের টাকা ফেরত দেয়া নিয়ে আমরা তিতাসকে চিঠি দিয়েছি অনেক আগে। তারা চিঠি অনুযায়ী একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে শুনেছি। তবে এখনো কেন গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়নি, সেটি আমরা জানতে চাইব। মন্ত্রণালয় থেকে আমরা ডিমান্ড নোটের টাকা অনলাইনে কিংবা বিকাশে দিয়ে দিতে বলেছি।
নতুন করে সরকারের গ্যাস সংযোগ দেয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই জানিয়ে এ সচিব বলেন, ফলে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতেই হবে। এ টাকা আটকে রাখা যাবে না। যেহেতু আর গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে না, তাই যারা গ্যাস ব্যবহার করতে চান তাদের এলপিজি ব্যবহার করতে হবে।
তবে ডিমান্ড নোটের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে জ্বালানি বিভাগের দেয়া আদেশে কোনো সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ কতদিনের মধ্যে এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে হবে, তা চিঠিতে উল্লেখ নেই। ফলে এখানে এক ধরনের ফাঁক রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ দীর্ঘসূত্রতায় হতাশ হয়ে পড়েছেন ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দেয়া প্রায় ৫৬ হাজার আবেদনকারী। সরকার যদি গ্যাসের নতুন সংযোগ না দেয়ার সিদ্ধান্তই নিয়ে থাকে, তাহলে কেন গ্রাহকদের টাকা আটকে রাখা হয়েছে; সে প্রশ্ন রাখেন তারা।
ভুক্তভোগী কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। তাদের একজন রাজধানীর আদাবর এলাকার বাসিন্দা রিসালত হোসেন। তিনি জানান, ২০১৭ সালে তার নতুন ভবনের জন্য তিতাসের কাছে গ্যাস সংযোগের আবেদন করেন। সেই থেকে ডিমান্ড নোটের টাকা তিতাসের কাছে পড়ে আছে। তার পরিচিত আরো অনেকেরই এ অবস্থা। এ ভোগান্তি বা অপেক্ষার অবসান হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
রাজধানীতে গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত রয়েছে তিতাস। সংস্থাটি গ্রাহক সংখ্যার দিক থেকেও শীর্ষে। সাড়ে ২৮ লাখের বেশি গ্রাহকের কাছে দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সরবরাহ করছে তারা। কিন্তু অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়া, বকেয়া, গ্রাহক ভোগান্তিসহ নানা ধরনের দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে সংস্থাটির বিরুদ্ধে।
দেশে গ্যাস সংকটের প্রেক্ষাপটে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১৩ সালের শেষের দিকে আবারো আবাসিকের সংযোগ চালু করা হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের পর আবারো জ্বালানি বিভাগ থেকে অলিখিতভাবে বিতরণ কোম্পানিকে আবাসিকের নতুন আবেদন নিতে নিষেধ করে দেয়া হয়। পরে ২০১৯ সালে লিখিতভাবে আবাসিক সংযোগ স্থগিত রাখার আদেশ জারি করা হয়। কিন্তু ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত গত আট বছরে তিতাস গ্রাহকের কাছ থেকে ডিমান্ড নোটের টাকা জমা নিয়েছে। ফলে এ সময়ের মধ্যে ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দেয়া গ্রাহকদের টাকা দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে সংস্থাটির কাছে।