যশোর-খুলনার জলাবদ্ধতা নিরসনে

0
197

এম আর খায়রুল উমাম

‘মনিরামপুরে ৩৩ হাজার বিঘা কৃষিজমি পানির নিচে। বিএডিসি তাদের সেচযন্ত্র ব্যবহার করে পানি সরিয়ে ২ হাজার ২০০ বিঘা জমি চাষের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছে। আগামীতে আরও ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ২০ হাজার বিঘা জমি চাষের উপযোগী করা যাবে’- কিছুদিন আগে এমন একটি তথ্য চোখে পড়েছিল। যশোর অঞ্চলের জলাবদ্ধতার চিত্র ৩০-৪০ বছর ধরে এমনই। সরকারি উদ্যোগে কিছু সময়ের জন্য অবস্থার সামান্য উন্নতি হলেও তা আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এলাকার মানুষ এই সংকটের মধ্যেই বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালাচ্ছে। গত শতকের ষাটের দশকে কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট প্রজেক্ট করে ওয়াপদা বা বর্তমানের বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশে লবণাক্ততা ও বন্যা প্রতিরোধে ২০০০ মাইল বাঁধ, ৭৮০টি স্লুইসগেট ও ৯২টি পোল্ডার নির্মাণ করে। এই পোল্ডারের ২৪ ও ২৫ নম্বর বিল ডাকাতিয়া, বিল বকর, বিল কেদারিয়াসহ অন্যান্য বিলে আশির দশক থেকে জলাবদ্ধতা শুরু হয়। এবং তা দিনে দিনে বেড়ে চলার ফলে নাগরিকদের চলতে থকে মানবেতর জীবনযাপন।

যশোর-খুলনা অঞ্চলের ৩৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রায় ১০ লাখ মানুষের দুঃখ ভবদহ। মানুষের দুর্দশা লাঘবের নামে কত প্রকল্প হলো; কত টাকা এ পর্যন্ত ব্যয় হলো! কিন্তু জলাবদ্ধতা থেকে আজও মুক্তি পাওয়া গেল না। প্রতি বছর জলাবদ্ধতার রূপ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। জলাবদ্ধতা সৃষ্টিকারী পোল্ডারের আউট হিসেবে আপার ভদ্রা, শৈলমারী, হরি নদী খনন করে নাব্য আনার চেষ্টা হয়েছে। জলাবদ্ধ এলাকার নিম্নাঞ্চলে আরও বড় আকারের রেগুলেটর নির্মাণ করা হয়েছে। অবস্থার আপেক্ষিক উন্নতি ছাড়া কিছুই হয়নি। দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের নদী খননের নামে যা হয়ে থাকে, তাতে নদী তার প্রকৃত অবস্থা ফেরত পায় না। নদীর প্রশস্ততা আগের অবস্থায় না এনে তলদেশ খানিকটা খনন করে পানির প্রবাহ দৃশ্যমান করা হয়ে থাকে। এখানেও নদীখনন কাজে কোনো ব্যতিক্রম না হওয়ায় জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব হয়নি। অতীতে রেগুলেটর নির্মাণের ফলে জোয়ারের পানি পোল্ডারে প্রবেশ করতে না পারায় নদীগুলো ভরাট হয়েছে। ষাটের দশকের প্রকল্প ১০-১২ বছরে মানুষের দুঃখে পরিণত হয়েছে।

ভবদহ আন্দোলনের নেতারা জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির পথ হিসেবে জোয়ারাধারকে বিবেচনা করছেন। সম্মিলিতভাবে জোয়ারাধার নির্মাণে জোর আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে। অনেক বিশেষজ্ঞ রেগুলেটর ও জোয়ারাধারের তুলনামূলক বিশ্নেষণে যশোর-খুলনার জলাবদ্ধতা নিরসনে জোয়ারাধারকেই অধিক কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে মত প্রকাশ করেছেন। ২০০৬ সালে এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম জোয়ারাধার সৃষ্টির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। তিন বছরের কাজ সাত বছরেও শেষ করতে না পারায় ২০১৩ সালে তা বাতিল করে দেওয়া হয়। তাই জোয়ারাধার জলাবদ্ধতা নিরসনের অধিক কার্যকর উপায়- তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ভুল নদীশাসনের ফলে লবণাক্ততা ধেয়ে আসছে। পানিতে লবণের সহনীয় মাত্রা কতদিন থাকে, তা বিবেচনায় রাখা খুব প্রয়োজন। জোয়ারাধারে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করিয়ে বিলের জমি উঁচু করা হলে আম-ছালা সব যাবে।

যশোর-খুলনার জলাবদ্ধতা সৃষ্টি ও তা থেকে মুক্তির পথ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকায় আছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৪০ বছর ধরে এ এলাকা জলাবদ্ধ। বিপন্ন মানুষ বাঁচার তাগিদে চিৎকার করে চলেছে, আর শাসক শ্রেণি একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড মানুষের মনে এতটাই ভীতির অবস্থা তৈরি করেছে; তারা এ কর্তৃপক্ষের ওপর নূ্যনতম আস্থা রাখতে পারে না। এলাকার মানুষ বিশ্বাস করে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রমে মানুষের দুর্দশা বাড়বে; মুক্তি আসবে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর-খুলনার জলাবদ্ধতা নিরসনে নতুন প্রকল্প তৈরি করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় জলাবদ্ধ এলাকায় ১০৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার নদী পুনর্খনন, বিভিন্ন খালের ওপর ১৯টি কালভার্ট নির্মাণ, ৫০ দশমিক ২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, একটি স্লুইসগেট নির্মাণ ও ১৯টি স্লুইসগেট মেরামত করা হবে। এ কাজে ব্যয় হবে ৬৫৫ কোটি ৮৮ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। জবাবদিহিহীন শাসন ব্যবস্থায় এ প্রকল্পের দায়ভার নিয়ে যে কোনো প্রকল্প পরিচালক জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তিতে এগিয়ে এলে মানুষ খুশি হবে। নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রকল্প পরিচালক জনগণ চায় না। প্রকল্পের মেয়াদ শেষে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে- তার প্রমাণ রেখেই পরিচালককে প্রকল্প শেষ করতে হবে। সফল হলে তিনি পুরস্কৃত হবেন; আর তা না হলে তিরস্কৃত হয়ে ক্ষতিপূরণ দেবেন। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে এভাবেই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ও দায়িত্ব দিতে হবে। প্রকল্প পরিচালক হওয়ার ইঁদুর দৌড়ের অংশীদার করা যাবে না। উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার দৌড়ে আছি আমরা। এখানে দায়িত্ব নিয়ে প্রকল্প শেষ করার সময় কোথায়? সংশ্নিষ্ট সবাই উন্নয়নের পেছনে ছুটে চলেছে। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে একের পর এক প্রকল্পের মিছিল চলেছে। তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ করার দায় গ্রহণ করার সময় নেই সংশ্নিষ্টদের। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, অর্থনৈতিক সমীক্ষায় লিখে দেবে- বাঁধের ওপর কলা ও কচু লাগিয়ে প্রকল্প ব্যয় উঠে আসবে, আর এতেই সবাই আনন্দ পাবে।

যশোর-খুলনার জলাবদ্ধতা নিরসনে বিলের ভেতরে জোয়ারের পলিযুক্ত পানি প্রবেশ করিয়ে বিলের তলদেশ উঁচু করাকেই সমাধান, মুক্তির পথ হিসেবে বিবেচনা করছে সংশ্নিষ্ট সবাই। এখন প্রশ্ন হলো, কী পদ্ধতিতে সুচারুভাবে বিলে জোয়ারের পানি প্রবেশ করার ব্যবস্থা হবে? বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন একটা প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে বৃহত্তম সংগঠন আইডিইবি প্রায় ২৫ বছর আগে বিলের পানি বের করা ও প্রবেশের উপায় হিসেবে পাম্প হাউস নির্মাণের প্রস্তাব রেখেছিল। আইডিইবির প্রস্তাব অনুসারে এক হাজার কিউসেক সাইজের ৩টি ড্রেনেজ-কাম ইরিগেশন পাম্প স্টেশন জলাবদ্ধ এলাকার জমিকে ব্যবহারোপযোগী রাখতে পারবে। এতে জোয়ারাধার করে বছরের পর বছর জমিকে বন্ধ্যা রাখতে হবে না। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে সুলভ কোনো প্রকল্প গ্রহণযোগ্য হয় না। প্রকল্পের সাফল্যের হার অর্থের পরিমাণ দিয়ে বিবেচিত হওয়ায় এ প্রস্তাব নীতিনির্ধারকদের নজর এড়িয়ে যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত বিএডিসির ছোট্ট এক সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে আইডিইবির ২৫ বছরো পুরোনো প্রস্তাবনাকে আমলে নিয়ে শাসক শ্রেণি পাম্প হাউস নির্মাণ করে জলাবদ্ধতা নিরসনে উদ্যোগী হতে পারে।

প্রাবন্ধিক; সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ
khairulumam1950@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here