ভারতে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি মারাত্মক হয়ে ওঠায় প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে স্থলপথের যোগাযোগ দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাশিতই ছিল। ভারতে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ইতোমধ্যে যে চিকিৎসা সংকট তৈরি করেছে, দুই দেশের মধ্যে চলাচলকারী যাত্রীর মাধ্যমে বাংলাদেশও সংক্রমিত হলে তা সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। যে কারণে বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই আকাশপথে চলাচল বন্ধ করা হয়েছিল। এখন স্থলপথেও যাত্রী চলাচল বন্ধ রাখার মধ্য দিয়ে ওই পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা স্বাভাবিক। কিন্তু বিষয়টি যাতে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত ইতোমধ্যে এই শঙ্কা জোরালোও হয়েছে। দেখা গেছে, ভারত থেকে করোনা লক্ষণ নিয়ে আসা কয়েকজন যাত্রীকে হাসপাতালে সঙ্গনিরোধ করে রাখা হলেও তারা ‘পালিয়ে’ গেছেন বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ। এই সংখ্যা যদি আরও বাড়তে থাকে, তাহলে তো সকলই গরলভেল!
মনে রাখতে হবে, গত এক মাসে বাংলাদেশেও সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় লকডাউনের সর্বব্যাপ্ত বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখন চলছে নানা বিধিনিষেধ। ঢাকায় আক্রান্ত বিভিন্নজনের নমুনায় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা বেশি সংক্রমণশীল ও প্রাণঘাতী একটি করোনা ‘স্ট্রেইন’ ঢাকার মধ্যেই আবদ্ধ রাখার চেষ্টা চললেও বাস্তবে এটা বহুলাংশে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। এর ওপর ভারতে ছড়িয়ে পড়া নতুন ধরন যদি যোগ দেয়, তাহলে সামলানো কঠিন হবে। এখন আমরা দেখতে চাইব, সীমান্তের বিধিনিষেধ প্রতিপালনে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। যাত্রী চলাচল বন্ধ থাকলেও পণ্য চলাচল চালু থাকছে। পণ্য আনা-নেওয়া ও খালাসের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি যাতে মানা হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষেরই। এক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতারও অবকাশ নেই। গত এক বছরে বাংলাদেশেই একাধিকবার প্রমাণ হয়েছে যে, কর্তৃপক্ষের গদাই লস্করি চালের জন্য করোনাভাইরাস কখনও বসে থাকে না। বিধিনিষেধ প্রতিপালনে বিন্দুমাত্র ছাড় জীবন নিয়ে খেলার নামান্তর। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বল্পোন্নত বাংলাদেশ প্রথম থেকে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা হলেও সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে অবশ্য প্রশ্নের অবকাশ নেই।
অর্থনৈতিক সামর্থ্য, অবাকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও কারিগরি দক্ষতার কথা যদি ভাবি- তাহলে স্বীকার করতেই হবে, দক্ষিণ এশিয়া ও বাকি বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় এ পর্যন্ত আমাদের পরিস্থিতি মন্দের ভালো। একই সঙ্গে টিকাকরণ কর্মসূচিও এগিয়ে চলছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক এই সুরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় না আসা পর্যন্ত বজ্র আঁটুনি চালিয়ে যেতে হবে। বিশেষত আকাশ, স্থল, এমনকি নৌপথেও সতর্কতা ও নজরদারির বিকল্প নেই। আমরা দেখেছি, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এশিয়া মহাদেশের চীন, ভিয়েতনাম বা থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো সফল হয়েছে মূলত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই এ ব্যাপারে পুনঃপুনঃ তাগিদ দিয়েছিলাম। বলেছিলাম যে, দেশের প্রবেশপথগুলোতে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ জোরদার করে করোনা শনাক্ত বা সন্দেহভাজনদের সঙ্গনিরোধের ব্যবস্থা করা হোক। দুর্ভাগ্যবশত, সেটা করা সম্ভব হয়নি। যদি হতো, তাহলে সম্ভবত আমাদের দেশের পরিস্থিতি আরও স্বস্তিকর থাকত।
আমরা চাই, বিলম্বে হলেও এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গৃহীত হবে। আকাশ ও স্থলপথে যে বিধিনেষেধ দেওয়া হয়েছে, তা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হবে। আমরা বিশ্বাস করি, যথেষ্ট সংক্রামক হওয়া সত্ত্বেও করোনাভাইরাসের পুরোনো ‘স্ট্রেইন’ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ দক্ষতারই পরিচয় দিয়ে এসেছে। নতুন ধরনগুলো মোকাবিলায় সীমান্ত সুরক্ষার বিকল্প নেই। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের অবহেলা বা ঔদাসীন্যের কারণে এগুলো একবার দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে গেলে ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি যে বহুগুণে বেড়ে যাবে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বস্তুত এসব বিষয়ে আলোচনা গত এক বছরে কম হয়নি; এখন প্রয়োজন কাজ। আমরা সেটা দেখার জন্যই অপেক্ষা করব।