খান মো. রবিউল আলম
করোনার প্রাদুর্ভাবে আক্রান্তরা পরিসংখ্যানে রূপান্তরিত হচ্ছে। ওয়ার্ল্ডমিটার বা আইইডিসিআর সবখানে পরিসংখ্যানগত উপস্থাপন। কমবেশি সবাই শঙ্কিত কখন পরিসংখ্যানে পরিণত হয়। পরিসংখ্যানের তালিকায় ওঠা মানে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। করোনায় বাংলাদেশের গত সপ্তাহের মৃত্যুর সংখ্যা ১০১, ১০২, ১০২ এবং ১১২। সংখ্যাগুলো নিকষ, কালো ও খটমটে। এগুলোর ভেতর মানুষের কোনো মুখ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো প্রতিটি সংখ্যা একেকটি গল্প। বেঁচেবর্তে থাকার নিরন্তর লড়াইয়ের দীর্ঘপ্লট। পরিসংখ্যান মোটের ওপর চোখ বুলাতে শেখায়, কোনো স্বতন্ত্র সত্তার ওপর নয়।
সংবাদপত্র ছেপেছে, রিকশায় ১১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে করোনা আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন এক পিতা অথবা পিঠে অপিজেন সিলিন্ডার বেঁধে মোটরসাইকেলে করোনা আক্রান্ত মাকে নিয়ে সন্তান ছুটছেন হাসপাতালে। এগুলো একেকটি সংখ্যা। কিন্তু গল্পগুলো কত বড়, কত মানবিক আবেদনময়ী?
মনে রাখতে হবে, প্রতিটি জীবন যেমন অনন্য, তেমনি প্রতিটি মৃত্যুও স্বতন্ত্র। জীবন বা মৃত্যুর কোনো গড় হিসাব মানা যায় না। করোনা মৃত্যুর গড় হিসাব কষতে শিখাচ্ছে। মানুষের বহুমাত্রিক পরিচয়ের বিপরীতে এখন দাঁড়িয়েছে একমাত্রিক পরিসংখ্যান।
একসময় উত্তরাঞ্চলে মঙ্গাপীড়িত হাজার হাজার লোকের খাদ্যাভাবের কথা পাঠক জানত। এই হাজার হাজার সংখ্যা যত না আবেদন জাগায়, তার চেয়ে অনেক বেশি আবেদন জাগায় মোনাজাত উদ্দিনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘মনু মিয়া মৃত্যুর আগে দুধ কলা খেয়েছিল’। মনু মিয়া মারা যাওয়ার পর বেশ হৈচৈ পড়ে যায়। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে তৎকালীন সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে। সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মনু মিয়া মৃত্যুর আগে দুধকলা খেয়েছিল। অর্থাৎ তিনি খুব ভালো খাবার খেয়ে মারা গেছেন। কিন্তু মোনাজাত উদ্দিন অনুসন্ধান করে বের করেন- অভাবের তাড়নায় কচু-ঘেচু খেয়ে মনু মিয়া যখন পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন, তখন তিনি দুধ-কলা খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মনু মিয়াকে খাওয়ার জন্য দুধ-কলা দেওয়া হয়। দুধ-কলা খাওয়ার পর মনু মিয়ার পেটের পীড়া আরও বেড়ে যায়। কলেরা তীব্র হয়। শেষ অবধি তিনি মারা যান। এই একটি মৃত্যু মঙ্গা পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করে অন্যভাবে।
পরিসংখ্যান বড় না ছোট সেটা বড় কথা নয়- কথা হলো তা থেকে বাস্তবতার কতটুকু ধারণা পাওয়া যাচ্ছে সেটাই। মোদ্দা কথা, মানুষ যখন পরিসংখ্যানে পরিণত হয়, তখন তা কল্যাণকর হয়- না এমন বিশ্বাস আমাদের লোকজ চিন্তায় পাওয়া যায়-‘গুণতির বছর মড়কি লাগে’ অর্থাৎ যে বছর আদম শুমারি হয়, সে বছর কোনো না কোনো দুর্যোগ দেখা দেয়, প্রাণহানি ঘটে। ইতিহাসে তার নজির রয়েছে। এখানকার বড় বড় দুর্ভিক্ষগুলোর কথা ভাবা যেতে পারে। অর্থাৎ পরিসংখ্যান হয়ে ওঠার আশঙ্কা মানুষকে ভীত ও অসহায় করে তোলে। করে তোলে পরিচয়হীন। মহামারি, দুর্ভিক্ষ বা যুদ্ধবিগ্রহে পরিসংখ্যানের কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকে পড়ে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী। যেমন, ধরুন দুটি বিশ্ব ও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ। এই সংখ্যার ভেতর আপনজন কেউ না থাকলে আপনি একটি মুখও স্মৃতিতে আনতে পারবেন না। পরিসংখ্যান সবসময় পূর্ণাঙ্গ বাস্তবতা তুলে ধরতে পারে না। এর মূল বিষয় হলো- পরিসংখ্যান কেবল নিজেকে প্রকাশ করে অন্যসব মাত্রা নির্গুণ করে।
বড় সংখ্যা দেখা যায়, কিন্তু এর মাইক্রো সেগমেন্ট নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেয়। আরেকটু খোলসা করি, আইইডিসিআর প্রতিদিন যে পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে, সেখানে করোনায় নিহতের একটি সংখ্যা থাকে। এ সংখ্যার দ্বিতীয় বিভক্তি হলো- কতজন নারী কতজন পুরুষ মারা গেছে। লিঙ্গভিত্তিক এ বিভাজন বিশেষ কোনো অর্থ বহন করে না। খুব ভালো হতো, যদি এ বিভাজনের শ্রেণিবিন্যাসটা আরও বিস্তৃত হতো। পরিসংখ্যানের এ ফাঁদটা বুঝতে না পারলে প্রকৃত ঘটনা কী ঘটছে, তা জানা যাবে না; অর্থাৎ কোন শ্রেণি বা পেশার মানুষ বেশিমাত্রায় করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যুর পরিসংখ্যান উৎকণ্ঠা তৈরি করে, ব্যথা জাগায় না। কারণ সংখ্যার কাজ মস্তিস্কে, হৃদয়ে নয়। পরিসংখ্যানে গল্প নেই, নেই জয়-পরাজয় আর আবেগ-অনুরাগের অনুরণন।
শৈলেন সরকার ‘দুর্ভিক্ষের সাক্ষী-৪৩-এর মন্বন্তর পার করা ৫০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান’ বইয়ে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন- সমাজে মন্বন্তরের অভিঘাত কত গভীরে ছিল। কারা বেশি দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছে, খাদ্যের রাজনীতি, সামাজিক পরিস্থিতি, দুর্ভিক্ষকালীন খাদ্যের রেসিপির হৃদয়বিদারক বিবরণ রয়েছে এই বইয়ে। আজকে করোনার পরিসংখ্যান একরৈখিকতা পেয়েছে। এটি কেবল মৃত্যু, আক্রান্ত ও সুস্থতার খতিয়ান হয়ে উঠেছে।
করোনাকালে আমরা দুই ধরনের পরিসংখ্যান দেখি; একটি পরিসংখ্যান অবস্থা তুলে ধরে যা গণমাধ্যমে উপস্থাপিত হয় বিকেল সাড়ে ৪টায়। দ্বিতীয়টি হলো- অবস্থান অর্থাৎ লাশের হিসাব-কবরস্থান। কবরের কাঁচাজমিন বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। গত কয়েক দিনে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলো পরিবীক্ষণ করে কবরস্থানগুলোর অবস্থান বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকার একটি অন্যতম বৃহৎ কবরস্থান হলো রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবীর পেছনের অংশটি। এর আয়তন ৯৩ একর। এ কবরস্থানের ব্লক-বি করোনা সংক্রমণে মৃতদের দাফনের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গোরখোদকরা জানাচ্ছেন- প্রতিদিন মধ্যরাত পর্যন্ত তাদের কবর খুঁড়তে হয়। নিহতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গোরখোদকরা কবর খুঁড়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এই কবরস্থানে একটি এপক্যাভেটর মেশিন দিয়েছে। প্রতিবেদনগুলো পরিবীক্ষণ করে দেখা গেছে- করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের অন্তিমশয়ান খুব নিঃসঙ্গ। জানাজায় লোকজন হয় না। ভয়, ভয় এবং ভয়। কেবল গুটিকয়েক আত্মীয়-স্বজন দাফন কাজটি সম্পন্ন করেন। পরিস্থিতি ক্রমশ নির্মম হয়ে উঠছে।
কবরের সারি কেবল মহামারিকালে দীর্ঘ হয় না। দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নেও সেই সারি দীর্ঘ হতে পারে। অরুন্ধতী রায় ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে একটি বক্তৃতা করেন। বিষয় ছিল দ্য মুসলিম গ্রেভিয়াড টক ব্যাক : ফিকশন ইন দ্য টাইম অব ফেক নিউজ। তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, কাশ্মীরবাসীর স্বাধিকার আন্দোলন দমনে ভারতীয় শাসক গোষ্ঠী যে নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তাতে কাশ্মীরে কবরের বিস্তৃত ঘটেছে ভয়াবহভাবে।
মহামারি, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ বা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন কোনোভাবেই মানুষ মেরে শেষ করা যায়নি। মানুষ অমর হয়ে উঠেছে। মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। নতুন নতুন সৃষ্টিশীলতায় মেতেছে মানুষ। মানুষ জীবন ও মৃত্যুর সাধনা করেছে সমানভাবে। অগ্রজ গুণীজনরা মৃত্যুর সাধনায় প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন।