গালির মধ্যেও লুকিয়ে আছে ক্ষমতার রাজনীতি

0
178

নিশাত সুলতানা
গালির প্রতি বাঙালির প্রীতি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। গালি বাংলা শব্দভান্ডারে বিশেষ করে মৌখিক শব্দসম্ভারে পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নিয়েছে। অশিক্ষিত কিংবা সমাজের নিম্নস্তরে বাসকারীরাই যে শুধু গালি দেন, তা কিন্তু নয়। শিক্ষিত এবং সমাজে কুলীন হিসেবে পরিচিতরাও হরহামেশা গালি দেন। এমনকি গুণী সাহিত্যিকদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যেও স্থান করে নিয়েছে গালি।

সাধারণভাবে বলা যায়, কাউকে মৌখিকভাবে আক্রমণের চরম অস্ত্র হিসেবে আমরা যে অশ্লীল শব্দগুলো প্রয়োগ করি, সেগুলোই গালি। অশ্লীলতার সংজ্ঞা এবং মাত্রা নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে মতভেদ থাকলেও গালি ব্যবহারের পেছনে শত্রুপক্ষকে বাক্যবাণে জর্জরিত করার বিষয়ে কারোরই দ্বিমত নেই। গালির আরেকটি প্রয়োগও রয়েছে। আদর, আশকারা কিংবা ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতেও গালি দেওয়া হয়। গালির তীব্রতা কিংবা মিষ্টতা পরিস্থিতি ও প্রয়োগের ওপর নির্ভরশীল। তারপরও বলতে দ্বিধা নেই, অধিকাংশ গালির অর্থ এবং প্রয়োগের সঙ্গে নারীর অধস্তন সামাজিক অবস্থানের রাজনীতি জড়িত।

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত গালি নিয়ে সম্প্রতি খানিকটা পড়াশোনা করেছি, সংগ্রহ করেছি বেশ কয়েকটি বই। গালিতে নারীর অসম্মানজনক উপস্থাপনের উপলব্ধিটি যদিও নতুন নয়; তারপরও নতুন করে বইগুলোর পাতায় পাতায় খুঁজে পেয়েছি নারীকে অপমানের ইতিহাস।

চলতি পথে, গণপরিবহনে, সহকর্মীদের আলোচনায়, পারিবারিক সমালোচনায়, বন্ধুদের আড্ডায় প্রায়ই হজম করতে হয় গালি। প্রতিবাদ জানালে উল্টো ‘নাক উঁচু’ খেতাব নিয়ে একঘরে হওয়ার আশঙ্কা; যেন গালি মেনে নেওয়াটাই স্বাভাবিকতা। বাংলা ভাষায় প্রচলিত গালির অধিকাংশই নারীর শরীর, মনস্তত্ত্ব, কর্মদক্ষতা, সামাজিক অবস্থান কিংবা তাঁর যৌনতাকে কটাক্ষ করে আবর্তিত।

অনেকেই দাবি করেন নিজের অজান্তে, অসচেতনভাবে গালি দেওয়া হয়। তবে আমার বিশ্বাস, গালি সচেতনভাবেই দেওয়া হয়। গালির সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতি জড়িত আছে এবং গালির প্রয়োগ করা হয় সচেতনভাবে স্থান, কাল এবং ব্যক্তি বিশ্লেষণ করে। ঊর্ধ্বতনরাই সাধারণত অধস্তনদের গালি দেন। ব্যতিক্রম ছাড়া অধস্তনরা কখনো ঊর্ধ্বতনের সামনে এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করেন না। আর যদি করেনও তবে ঊর্ধ্বতনের অলক্ষ্যে সেটি করেন।

প্রচলিত গালিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে পুরুষের যৌন অঙ্গের চেয়ে নারীর যৌন অঙ্গের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে অনেক গুণ বেশি। নারীর যৌন অঙ্গ কিংবা তাঁর যৌনতাকে ঘিরে গালিতে ফুটে ওঠে পুরুষের ধর্ষকামী চেতনা এবং বিকৃত বাসনা। নারীর যৌন অঙ্গকেন্দ্রিক শব্দ প্রয়োগেই যেন নিহিত থাকে পুরুষের বিজয়।
পুরুষের এই ধর্ষকামী মানসিকতা দ্বারা প্রভাবিত হন নারীও। একই সমাজে বেড়ে ওঠা নারীও স্বগোত্রের প্রতি অবমাননাকর এই শব্দগুলোকেই যুদ্ধজয়ের রসদ হিসেবে চিনতে শেখেন। যুগে যুগে গালিতে লালিত হতে থাকে নারীর সতীত্বের ধারণা আর নারীর কাছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশিত অধস্তন ভূমিকা।

একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, বাংলা ভাষায় বেশ কিছু স্ত্রীবাচক গালি আছে, যার পুরুষবাচক কোনো শব্দ নেই। যেমন ‘বেশ্যা’, ‘ছিনাল’, ‘মাগি’ ইত্যাদি। আবার নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ককেন্দ্রিক বেশ কিছু গালি আছে, যার অধিকাংশতেই নারীর যৌন অঙ্গ কিংবা যৌনতাকে যেভাবে বিকৃতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়, পুরুষের ক্ষেত্রে তা হয় না।

নারীর প্রতি ইঙ্গিত ছাড়া গালি যেন ঠিক পূর্ণতা পায় না। এ ছাড়া অগণিত ক্ষেত্রে নারীকে পশুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। যেমন ‘এঁদো গাই’ শব্দটির মাধ্যমে নারীকে গাভির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে শুধু তাঁর বন্ধ্যাত্ব প্রকাশ করার জন্য। এমনকি পুরুষবাচক গালিকেও সুকৌশল নারীর যৌনতার সঙ্গে মিশিয়ে নারীকে অপমান করা হয়েছে বারবার।

কিছু গালি আছে যার আদি অর্থ গুরুতর নেতিবাচক কিছু প্রকাশ করে না; অথচ এই শব্দগুলোর সঙ্গেও নারীর যৌনতাকে জুড়ে দিয়ে এগুলোকে অবনমিত করা হয়েছে। শিক্ষিত সমাজে দারুণ জনপ্রিয় ‘শালা’ এবং ‘শালি’ গালি দুটির মাধ্যমে কী অনায়াসে স্ত্রী এবং স্ত্রী-সম্পর্কীয় আত্মীয়স্বজনকে অপমান করা হয়েছে।

‘দাঁতাল’ শব্দের অর্থ বড় দাঁতের পুরুষ আর ‘দাঁতুলী’ অর্থ বড় দাঁতের নারী। যখন’ দাঁতাল’ শব্দটির উদাহরণ দেওয়া হয় ‘দাঁতাল কোনেকর, এই দিকে আয়’ তখন ‘দাঁতুলী’র উদাহরণ শুনুন: ‘দাঁতুলী মাগির দেমাগ দেখ না।’ একই গালির বৈষম্যমুক্ত প্রয়োগ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় গালি কীভাবে নারীর মর্যাদা ভেঙে চুরমার করে।

এই রকম উদাহরণ ভূরি ভূরি। আবার অনেক ক্ষেত্রে গালির অর্থে অশ্লীলতা না থাকলেও প্রয়োগে চোখে পড়ে অশ্লীলতা।

সমাজে বৈষম্য টিকিয়ে রাখার অন্যতম বড় হাতিয়ার হলো ভাষা। শব্দ নির্বাচন ও ভাষার ব্যবহারের সঙ্গে মিশে থাকে ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি। তাই ভাষাকে শুধু নিছক শব্দসম্ভার বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একটি সমাজে নারীর অবস্থান অনেকটাই প্রতিফলিত তাঁর প্রতি ভাষায় ব্যবহারে।

দুর্ভাগ্যজনক হলো, গালির ব্যবহারকারী তো বটেই, গালি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী বিভিন্ন লেখাতেও নারী অবমাননার এই বিষয়টির প্রতি বিশ্লেষকদের মনোযোগী হতে দেখি না। গালিগুলোকে উদারভাবে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখানোর ফলে বৈধতা পায় গালির মাধ্যমে নারীর প্রতি শোষণ, নির্যাতন আর অপমান। গালিকে শিল্পকর্মের সঙ্গে তুলনা করে গালির পরতে পরতে থাকা নারীর অপমানকেও মেনে নেওয়া হয়।

ভাষায় নারীর অপমান বন্ধ হোক। গালিতে নারীর অপমানের বিষয়টি তলিয়ে দেখতে হবে। কারণ, আমাদের ভাষায় নারীর অপমান, সে তো আমাদেরই অপমান।

লেখক ও উন্নয়নকর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here