বাঁশখালীতে শ্রমিক নিহত, অহেতুক সংঘাত, অগ্রহণযোগ্য রক্তপাত

0
199

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রে শনিবার শ্রমিক ও পুলিশ সংঘর্ষে অন্তত পাঁচজন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হওয়ার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন ও বিক্ষুব্ধ। পবিত্র রমজান মাসে যেখানে সবার সংযত থাকা প্রত্যাশিত, সেখানে পরিস্থিতি এতটা গুরুতর আকার ধারণ করল কেন? বিশেষত খেটে খাওয়া মানুষের এই রক্তপাতের কোনো যৌক্তিকতাই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ঘটনাপ্রবাহের বিশ্নেষণে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, এই সংঘাত ও প্রাণহানি চাইলেই এড়ানো সম্ভব ছিল। কোন পরিস্থিতিতে কাদের কারণে এভাবে শ্রমিক ও পুলিশ মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করেছিল এবং তার জের ধরে পাঁচ পাঁচটি মূল্যবান প্রাণ ঝরে পড়ল- ইতোমধ্যে গঠিত তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে তা স্পষ্ট হবে বলে প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে অতীতের আরও অনেক তদন্ত কমিটির মতো যদি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করা হয়, তার পরিণতি সুখকর হবে না। রোববার সমকাল অনলাইনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে, স্থানীয় পুলিশ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের তরফে দুটি পৃথক মামলা করা হয়েছে এবং সেখানে কমবেশি সাড়ে তিন হাজার জনকে ‘আসামি’ করা হয়েছে। এতে করে শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা মনে করি, এভাবে ঢালাও মামলা পরিস্থিতি আরও জটিলই করে তুলবে। ‘অজ্ঞাত’ বিপুল সংখ্যক আসামি মানেই যে নির্দোষ ও নিরীহ নাগরিকদের হয়রানির ফাঁদ- এমন নজির অতীতে বিভিন্ন সময়ই দেখা গেছে। প্রাণ, স্বজন ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্ত ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারানো শ্রমিকরা যদি মামলার কারণে বাড়তি বিড়ম্বনার শিকার হয়, তা হবে দুর্ভাগ্যজনক।

বিশেষ করে, সংঘাতে পুলিশ যেখানে সরাসরি পক্ষ, তাদের হাতে মামলার ‘অস্ত্র’ অপর পক্ষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বৈকি। পুলিশের উচিত ছিল অন্তত তাদের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা। পুলিশের পাশাপাশি জেলা প্রশাসন থেকে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তার প্রতিবেদন আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষেরও। এমন আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না যে, প্রতিপক্ষ যেহেতু শ্রমিকের মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, পুলিশ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ ‘গায়ের জোর’ দেখাতে চাইছে। এখানেই আসলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়। শনিবারই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিচার বিভাগীয় তদন্তের যে দাবি তোলা হয়েছে, আমরা তাতে সমর্থন জানাই। একই সঙ্গে রোববার দায়ের হওয়া দুই মামলায় যাতে কোনো ধরনের হয়রানি না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে, গুলিবর্ষণের প্রক্রিয়া যথাযথ ছিল কিনা। অহেতুক রক্তপাতের জন্য যারাই দায়ী, তাদের আইনের আওতায় আনতেই হবে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ সদস্যদের একটি অংশের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার বদলে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর হতে বাধ্য। এতে লাগাম দেওয়ার এখনই সময়।

আমরা বলব, বাঁশখালীর সংঘাতটিও ছিল অহেতুক। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে যেসব দাবি তোলা হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আলাপ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল না। তার বদলে দুই পক্ষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল কারা? গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আমরা এসব প্রশ্নের জবাব চাই। তবে সবকিছুর আগে আহতদের যথাযথ চিকিৎসা ও নিহতদের স্বজনের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিক ও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দূর করতে এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে। যে কোনো মূল্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ঘিরে স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তপাত কোনো পক্ষের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে না। মনে রাখতে হবে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পেছনে রয়েছে বিপুল বেসরকারি বিনিয়োগ। এর সঙ্গে রয়েছে বিদেশি অর্থায়ন। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ভূমি অধিগ্রহণকালেও সংঘাতে প্রাণহানি ঘটেছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার আগেই আরও একবার প্রাণহানি প্রমাণ করে যে, সেখানে অস্থিতিশীলতার ৃবেশি সুন্দর হতে যাওয়ার ফল !বীজ রয়ে গেছে। দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থেই তা দিনের আলোয় আনা জরুরি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here