লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল, শালিখা
২ বাংলার প্রিয় প্রখ্যাত লোকশিল্পী শালিখার বিরেন্দ্রনাথ রায় এর ৯০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে তার নিজবাড়ি শালিখার বরইচারা গ্রামে। কবির ৯০তম জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ৪ এপ্রিল রবিবার তার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কিছু কথা ও কিছু গান দিয়ে সান্ধ্যকালীন সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। কবি মানুষের আনন্দ উপভোগের জন্য তার জীবদ্দশায় ৩২টি অষ্টক পালা গানের বই ও ২৮টি যাত্রাপালা গানের বই লিখেছিলেন।
একসময়ে ১ টাকায় কেনা ৩২ পর্দার একটি হারমনি দিয়ে শুরু করেছিলেন তার লেখনীর গান গাওয়া। গান রচনা ও গাওয়ার পাশাপাশি তিনি মানুষের দৈহিক রোগ প্রতিহতের জন্য আজীবন তিনি হোমিও চিকিৎসক হিসাবে কাজ করে গেছেন। তার লেখা অষ্টক গান ও যাত্রা পালার বই গুলি ভারত বাংলার বিভিন স্থানে প্রচলিত থেকে আজও প্রশংশিত হয়ে চলেছে। জানা যায় ২০১২ সালে বাংলা একাডেমী তার অষ্টক গান ও যাত্রাপালার বইয়ের শ্রেষ্টতম অর্জন হিসাবে বিশেষ সন্মাননা ক্রেষ্ট ও নগদ ৫২ হাজার টাকা প্রদান করে। তার লেখা গান ও যাত্রাপালায় মুগ্ধ হয়ে নড়াইলের কলম সৈনিক পরিষদ ২০১২ সালের ১১ নভেম্বর তাকে শ্রেষ্ট গীতিকার ও নাট্যকার হিসাবে সম্মাননা সনদ প্রদান করে।
কবি বিরেন্দ্রনাথ রায় মাগুরার শালিখা উপজেলার বরইচারা গ্রামে ১৯৩২ সালের ৪ এপ্রিল জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম প্রিয়নাথ রায় ও মাতা জ্ঞানদা রায়। পিতা মাতা দুইজনই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিনি নিজেও ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বুধবার রাত ১১টায় নিজবাড়ি বরইচারা গ্রামে সকলকে কাদিঁয়ে পরপারে চলে যান। ১৬ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার তারঁ শেষ কৃত অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
তিনভাই তিন বোনের মধ্যে বিরেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন সকলেরই বড়। গরীব অসহায় হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহন করলেও শত অভাব অনটনের মধ্যেও গ্রামবাংলার সাড়া জাগানো লোকসংগীতকে তিনি হারিয়ে যেতে দেননি। অভাবের সংসারে কোন রকম খেয়ে না খেয়ে ভাবনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি নবম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন।
যে বয়সে তিনি স্কুলে লেখাপড়া করবেন ঠিক সেই বয়সে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন শিল্প সাধনার কলম। লিখতে থাকেন মানুষের আনন্দ উপভোগের জন্য অষ্টক গান ও জনপ্রিয় যাত্রা পালার বই। নিজ হাতে গড়ে তোলেন একাধিক অষ্টক গান ও যাত্রা পালার দল। রাতের পর রাত বিভিন্ন মঞ্চে অভিনীত হয়েছে তার সেই সব সাড়া জাগানো অষ্টক ও যাত্রা পালা। যে পালা দেখার জন্য ভারত ও বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ ঘুম হারাম করে উপভোগ করে হৃদয় জুড়ায়ে তৃপ্ত হয়েছিলেন।
তার লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে বন্ধনা, চন্ডিদাস রজকিনী, মানভঞ্জন, খুদিরামের ফাঁসি, সীতা হরন, ধরাদ্রনো, অচৈতন্য ভগবান, প্রহাদ চরিত্র, কৃষ্ণ কালী, সুজন মাঝি, রাম বনবাস সহ ৩২টি অষ্টক পালা গানের বই। যাত্রাপালা গানের বইযের মধ্যে রয়েছে কর্নফুলী, বেদের মেয়ে জো¯œা, তুলসী বনের বাঘ, রামকৃষ্ণ অপেরা, দস্যু কালোকোকিল, হরি যাত্রা, পুস্পবনÍ কলি সহ ২৮টি বই। এসব অষ্টক গান ও যাত্রাপালার বই তিনি দির্ঘকাল ধরে ল্যাম্পের আলোই বসে বসে লিখেছিলেন। প্রতিবেদনে উল্লেখিত সকল বিষয়াদি তাঁর জীবদ্দশায় তিনিই বলেছিলেন।
বিরেন্দ্রনাথ রায়ের পরিবারের লোকজন বলেন লেখকের অনেক অষ্টক গান ও যাত্রাপালার পান্ডুলিপি গুলি কয়েক বছর আগে মাগুরা সদরের আসবা গ্রামের বিকাশ নামের জনৈক এক ব্যক্তি বিরেন্দ্রনাথ রায়ের নামে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় নিয়ে যায়। কিন্তু কোনদিন তা প্রকাশও করেনি ফেরতও দেননি।
তার লেখা গান ও যাত্রা সারা বাংলাদেশ তথা ভারত বাংলার মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিলেও অর্থাভাবে তিনি নিজেকে কোনদিন প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। এব্যাপারে গ্রামের লোকজন বলেন কোন সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তার অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি গুলি প্রকাশ পেত। এতে বাংলার লোকসাহিত্যের ভান্ডার যথেষ্ট সমৃৃদ্ধ হতো।