আবু নাসের অনিক
করোনা সংক্রমণের ‘ইমপোজড ওয়েভ’ শুরু হয়েছে দেশে। চলমান সংক্রমণের ওয়েভ যদি পর পর চার সপ্তাহ দেড়গুণ হারে বাড়ে, শনাক্তের হার ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ শতাংশ বা তার উপরে পৌঁছায় সেই পরিস্থিতিকে ‘ইমপোজড ওয়েভ’ বলা হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: মুশতাক হোসেন বলেন,‘দেশে করোনায় সংক্রমিতের সংখ্যা ছয় লাখ ছাড়িয়েছে মানে হলো, বিরতি ছাড়াই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। আমরা যে গুরুতর জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির মধ্যে আছি, সেই বার্তাই দিচ্ছে এই সংখ্যা’।
অনেকেই একে ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ বলছেন। এটি সেকেন্ড ওয়েভ নয়। কারণ সেকেন্ড ওয়েভ তখন বলা যেতে পারে, যখন প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসার পর আবারো নতুনভাবে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ড অনুসারে করোনা সংক্রমণ কখনো নিয়ন্ত্রিত জায়গায় পৌঁছেনি। কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করলেই সেটি বোঝা যাবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সংক্রমণের সর্বশেষ চুড়ান্ত পর্যায় থেকে টানা তিন সপ্তাহে যদি রোগী ও সন্দেহভাজন অন্তত ৫০% কমে, অন্তত ৮০% সংক্রমণ যদি নির্দিষ্ট ক্লাস্টারে হয়। অন্তত পর পর চার সপ্তাহ যদি পরীক্ষা করা নমুনার (নুন্যতম ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা, যার মধ্যে স্ক্রিনিং টেস্ট ৫% এর বেশি নয়) ৫ শতাংশের কম পজিটিভ হিসাবে শনাক্ত হয়, তিন সপ্তাহ ধরে যদি মৃত্যু ও সন্দেহজনক মৃত্যু কমতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সেই অনুযায়ী সংক্রমণের হার শুধুমাত্র ৫% এর নীচে নামা ছাড়া অন্য কোন শর্ত পূরণ হয়নি! সংক্রমণের হার ৫% এর নীচে নেমেছিলো সেই সময় টেস্টের সংখ্যা ছিলো ১২-১৫ হাজার, স্ক্রিনিং টেস্ট (বিদেশগামী যাত্রীদের) ছিলো তার মধ্যে প্রায় ৫০%। এ কারণেই দেশে সংক্রমণের যে উর্দ্ধগতি দেখা যাচ্ছে এটি ‘ইমপোজড ওয়েভ’।
এই মুহুর্তে সংক্রমণ খুবই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, রোগীর অবস্থা অপেক্ষাকৃত বেশি জটিল হয়ে যাচ্ছে, আগে তরুণদের আক্রান্তের হার কম থাকলেও এবার তারাও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আক্রান্ত হচ্ছে। হঠাৎ করেই শ্বাস কষ্ট শুরু হচ্ছে, হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগীর হাই-ফ্লোজেন অক্সিজেনের দরকার হচ্ছে, আর সর্বপরি যে সমস্ত রোগীকে আইসিইউ তে নেয়া হচ্ছে তাদের অনেককে সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
বেশি বেশি সংক্রমিত হওয়া ও রোগের জটিলতার কারণে অনেক রোগীর এক সাথে হাসপাতালে ভর্তি হবার প্রয়োজনে, সাধারণ বেড পাওয়া যেমন কঠিন হয়ে যাচ্ছে একই সাথে আইসিইউ পাওয়া আরো বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেজিস্টার ডা: রাজিব দে সরকার বলেন,‘সরকারি-বেসরকারি কোভিড হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না। চাইলেও রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না। আমি করোনাতে আক্রান্ত হলেও ভর্তি হতে পারবো না’। পরিস্থিতি কতোটা বিপর্যয়কর!!
একজন করোনাক্রান্ত রোগীর আত্মীয় ৯ হাসপাতাল ঘুরে একটি বেড না পেয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলেন,‘শুনছিলাম পরিস্থিতি খারাপ, কিন্তু এতোটা খারাপ তা নিজের বেলায় না ঘটলে বুঝতাম না। পরিস্থিতি ভয়ানক, খুব ভয়ানক। স্বাস্থ্যখাতের সঙ্গেই রয়েছি, ভেবেছিলাম একটা বেড অন্তত ম্যানেজ করতে পারবো। পারলাম না। অন্যদের কী ভোগান্তি হচ্ছে সেটা ভাবতেও পারছি না’। আমরা এই মুহুর্তে ভাবতে না পারার জায়গায় পৌঁছে গেছি, তারপরেও আমাদের বোধদয় ঘটছেনা, নির্মম ট্রাজেডি!
রাজধানীতে করোনা রোগীদের জন্য সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে ২৯৬ টি আইসিইউ বেডের মধ্যে এই মুহুর্তে ফাঁকা আছে মাত্র ৫০টি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন,‘বর্তমান সময়ে রোগীরা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এক্সিস্টিং ক্যাপাসিটিতে সামাল দেওয়া কঠিন’। গত সপ্তাহে (১৬-২২ মার্চ) রোগী শনাক্ত হয়েছিলো ১৪ হাজার ৫১৯, চলতি সপ্তাহে (২৩-২৯ মার্চ) শনাক্ত হয়েছে ২৭ হাজার ২০৮। সংক্রমণ বৃদ্ধির হার প্রায় ১৫৫ শতাংশ। গত সপ্তাহে মৃত্যু ছিলো ১৪৯, চলতি সপ্তাহে মৃত্যু ২২৯। আজকেও রোগী শনাক্ত ৫ হাজার ৪২, মৃত্যু ৪৫, সংক্রমণের হার ১৮.৯৪% (করোনা.গভ.ইনফো)। স্ক্রিনিং টেস্ট বাদ দিলে সংক্রমণের হার ৩০ এর উপরে হবে। পরিস্থিতি গত বছরের এই সময়ের চাইতে অনেক অনেক বেশি খারাপ।
এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১৮ দফা প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের নিকট পাঠানো হলে, সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে মন্ত্রী পরিষদ সচিব স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রস্তাবনাকে পাশ কাটিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে তা এই মুহুর্তের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি মোকাবিলায় খুবই হালকা পদক্ষেপ। অন্যদিকে প্রজ্ঞাপনের মধ্যে নেই কোন স্পষ্টতা ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো প্রস্তাবনায় উল্লেযোগ্য নির্দেশনা ছিলো, জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব অফিস-কারখানা বন্ধ রাখা, উপসানালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা (নিয়মিত নামাজে ৫ জন, অন্য সময় ১০ জন), সকল ধরনের জন সমাগম নিষিদ্ধ করা, হোটেল রেষ্টুরেন্টে বসে না খাওয়া, আন্তপরিবহন যোগাযোগ, শপিং মল, পর্যটন এলাকা, সকল ধরনের মেলা ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা লকডাউন করা। উল্লেখিত নির্দেশনা তিন সপ্তাহের জন্য পালন করা। তাদের নির্দেশনার মূল লক্ষ্য ছিলো পাবলিক মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করা, এ ধরনের পরিস্থিতিতে এটিই আসলে সবচেয়ে ইফেক্টটিভ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন,‘সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আগামী দিনগুলোতে কী করণীয়, সে বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক যে কমিটি আছে, তাদের পরামর্শক্রমে এ করণীয় ঠিক করা হয়েছে’।
অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির প্রস্তাবনা গ্রহণ না করে সরকারের পক্ষ থেকে সবকিছু সীমিত করে করার প্রজ্ঞাপন দিয়ে পুরো বিষয়টিকে গুরুত্বহীন করে ফেলা হলো। ‘সীমিত’ করার বিষয়টি তো আগের থেকেই নির্ধারিত ছিলো, কিন্তু সঠিকভাবে প্রতিপালন না হবার কারণেই তো বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখান থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ছিলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৮ দফা প্রস্তাবনা অনুসারে প্রজ্ঞাপন দেওয়া। এই সময়ের সংক্রমণ ও সামগ্রিক ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সরকারের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে সিরিয়াসনেসের ছাপ নেই।
দেশে করোনা সংক্রমণের পূর্ব থেকেই সরকার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণে একেবারেই উদাসীন। লোক দেখানো অসংখ্য কমিটি করে রেখেছে, অথচ একটি কমিটির প্রস্তাবনাও গ্রহণ করে না। অন্য সব ক্ষেত্রের মতো এখানেও একজন ব্যক্তির সিদ্ধান্তই সবকিছু, সে বিষয়ে তাঁর জ্ঞান থাকুক আর না থাকুক! জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: বে-নজির আহমেদ বলেন,‘আমার কিছু প্রস্তাব ১৮ দফায় এসেছে। এখানে এমন কিছু জিনিস আছে যা কাজ করবেনা। আমাদের যে পরিস্থিতি তাতে ‘স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করা উচিত এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে প্রধান করে করোনা মোকাবিলা কমিটি গঠন করা উচিত, যে কমিটি প্রভূত ক্ষমতা নিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থার আওতায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারবে। স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থার মধ্যে তারা দোকান, রেস্তোরা, অফিস বন্ধ করার ক্ষমতা রাখবে’।
আমাদের পূর্বের অভিজ্ঞতা, সরকারের এই ‘সীমিত’ তত্ত্ব বাংলাদেশের জনগণের উপর প্রয়োগ করা প্রায় একটি অসম্ভব ব্যাপার। কারণ কোন কিছু প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ কর্তার বিষয়টি সিরিয়াসলি নেওয়ার ব্যাপার থাকে। এখানে দুই পক্ষের মধ্যেই সেটির অভাব রয়েছে। অনেকটা টম এ্যান্ড জেরির খেলার মতো। সরকার সবকিছু ঠিক রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, আর জনগণ সরকারের এই সবকিছু স্বাভাবিক রাখাকে মনে করে সবকিছু তো ঠিকই আছে!! এর মূল্য সরকার ও জনগণ উভয়কেই দিতে হবে।
সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, নাগরিকেরও দায়িত্ব আছে, তবে সরকার যেহেতু জনগণকে পরিচালনা করে সেক্ষেত্রে তার দায়িত্ব অনেক বেশি প্রাতিষ্ঠানিক। করোনা সংক্রমণের এই পরিস্থিতি সরকার চাইলে আগেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। সরকার বলছে, লাখ লাখ মানুষ পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরে, বিয়ে-পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, গেট টুগেদার আয়োজন করে, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে। আমার প্রশ্ন, তখন সরকার মসায় কী চোখ বন্ধ করে ছিলেন?? এটা জনগণ যাতে করতে না পারে সেটার জন্য তো আপনাদের হাতে সুনির্দিষ্ট আইন আছে, সেটির কেনো প্রয়োগ না করে সংক্রমণকে এই অবস্থায় নিতে দিলেন?? কারণ একটিই, আপনারা বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস ছিলেন না, সকল মনযোগ ছিলো জন্মশতবর্ষ আর সুবর্ণজয়ন্তীর দিকে! আপনাদের দেখাদেখি জনগণও ছিলোনা এবং এখনও নেই। সকল দায় জনগণের উপর দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চাইলে সেটা আরো জটিল হয়ে যাবে।
জনগণ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, সরকারের দায়িত্ব সেই পরিবেশ তৈরি করা। ডা: বে-নজির করোনা মোকাবিলায় একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটির কথা বলেছেন, সেটির আসলে প্রয়োজন নেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন -২০১৮’ নামে একটি আইন আছে। এই আইনের আওতাতেই ডা: বে-নজির যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলছেন সেটি নেওয়া সম্ভব। অথচ এই আইনের কোন প্রয়োগ নেই। সরকারের যতো আগ্রহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের! আর সিদ্ধান্ত তো আসে একজনের কাছ থেকে!!
ইতিমধ্যে এই কয়েকদিনে রোগী সামাল দিতে দিতে ডাক্তার-নার্স সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, রোগীর এই চাপ সামলাতে তারা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি খুবই নাজুক। মাননীয়া, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলুন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৮ দফা প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করুন, যতো সময় নিবেন, পরিস্থিতি ততোই হাতের বাইরে চলে যাবে!! মানুষের জীবন না বাঁচলে এই দেশ, অর্থনীতি, রাজনীতি সবকিছুই নিরর্থক হয়ে যাবে!!