পরিস্থিতি স্বাধীনতার দিকে গড়াচ্ছে
ফেব্রুয়ারিতেই বুঝতে পারে ওয়াশিংটন
— |
প্রিন্ট সংস্করণ

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে পরাশক্তিগুলো স্পষ্টই ছিল দুই মেরুতে বিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায় ‘ফরেন রিলেশন্স অব দি ইউনাইটেড স্টেটস, ১৯৬৯-১৯৭৬’ শীর্ষক দেশটির পররাষ্ট্রবিষয়ক দলিলে। এর একাদশ খণ্ডের ‘দক্ষিণ এশিয়া সংকট, ১৯৭১’ অধ্যায়ের আংশিক অবমুক্ত নথির ভিত্তিতে সমকালের জন্য ধারাবাহিক বিশ্নেষণ লিখেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ বীরেন্দ্র নাথ অধিকারী দক্ষিণ এশিয়ায় ঘটনাবলির যেমনটা ডালপালা ছড়াচ্ছিল, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জন করা ক্রমবর্ধমান হারে কঠিন বলে প্রমাণিত হচ্ছিল। বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবির কারণে পাকিস্তানে সংকট ঘনীভূত হচ্ছিল। এ কথা বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের উল্লিখিত নথির সম্পাদকীয় সংযুক্তির নোটে। এতে আরও বলা হয়, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলেই এ দাবিগুলোর পক্ষে সমর্থন মিলেছিল। এরপর ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সংকট গড়িয়ে পর্যায়ক্রমে তা যুদ্ধে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল। যুক্তরাষ্ট্র সে সময় চীনের সঙ্গে গোপন আলোচনা চালানোর জন্য পাকিস্তানকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। তবে লড়াই যখন তীব্র হয়, নিক্সন প্রশাসন তখন পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
১ মার্চ ১৯৭১ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল স্টাফের দুই সদস্য হ্যারল্ড স্যান্ডার্স ও স্যামুয়েল হসকিনসনের তরফে পাকিস্তান পরিস্থিতির ওপর কিসিঞ্জারকে একটি বার্তা পাঠানো হয়। তারবার্তায় প্রথমেই পাকিস্তানের ঘটনাবলি আজ এক বড় ধরনের মোড় নিয়েছে, যাতে স্বাধীনতার জন্য পূর্ব পাকিস্তান সম্ভাব্য আগাম পদক্ষেপের দিকে এগোচ্ছে বলে মন্তব্য করে নীতিগত কিছু সিদ্ধান্ত বিবেচনাসহ পরিস্থিতির একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন পেশ করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবিষ্যতের ঘটনাবলি পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ দলের প্রভাবশালী অন্যান্য নেতার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণভাবে ঢাকায় এখন উত্তেজনা বিরাজ করছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য স্বতঃস্ম্ফূর্ত মিছিল ও বিক্ষোভ চলছে। পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত প্রাদেশিক সরকার বিক্ষোভকারীদের শক্ত হাতে দমন করতে চাইলে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ কী করবে, তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে ধারণা করা যায়, তারা তাদের ছয় দফা দাবি থেকে সরে আসবেন না। কারণ, এর পেছনে তাদের আবেগ ও ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে।
এর পরে বঙ্গবন্ধুকে ‘রহমান’ নামে অভিহিত করে বার্তায় বলা হয় যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় উদ্বিগ্ন রয়েছেন এবং স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে আপস করতে রাজি নন। তা ছাড়া তিনি যখন ২৮ ফেব্রুয়ারি, রোববার রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে আলাপ করেন, তখন স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানকে সমর্থন এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে আন্দোলনের বিরুদ্ধে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার কথা বলেছেন। তাতে করে স্বাধীনতার বিষয়টি যে তার মাথায় রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
৪ মার্চ ১৯৭১ ওই দুই কর্মকর্তার পাঠানো আরেকটি বার্তায় কিসিঞ্জারকে বলা হয়- রাতারাতি পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত খবরে ইঙ্গিত বহন করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি অবনতিশীল। কারণ, শেখ মুজিবুর রহমান ১০ মার্চ ইয়াহিয়া খানের প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে সম্মেলন করার পরিকল্পনাকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে পূর্ব-পশ্চিম একসঙ্গে বসবাসের সম্ভাবনার দ্বার সম্পর্কে কার্যত সমালোচনা করেছেন বলে মনে হয়। মুজিব বেশ কয়েকজন বিদেশি সংবাদদাতার কাছে তার বক্তব্য কোথাও কোট না করার শর্তে স্বীকার করেছেন যে, তিনি রোববার (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার সমতুল্য কিছু একটা ঘোষণা করবেন। ৪ মার্চ পাঠানো বার্তায় পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের সামরিক প্রস্তুতি এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত পূর্ব পাকিস্তানিদের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্র বিদেশ দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।
আগামীকাল :৭ মার্চ নিয়ে উৎসুক ছিলেন কিসিঞ্জার