সত্যপাঠ ডেস্ক: একহার গড়নের চুল লম্বা মানুষ কী আদর্শিক ও দার্শনিকতায় খুব ঋজু হোন!নিবেদিত থাকেন মানুষ ও শিল্পের কাছে সমানভাবে।গণমানুষের অমিত সম্ভাবনা,তাদের গৌরব-উত্থানের ইতিহাসের প্রতি থাকেন নিয়ত শ্রদ্ধাশীল ও দায়বদ্ধ। শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতা থেকেই তাদের সম্ভাবনাকে-তাদের ইতিহাসকে স্বকাল থেকে মহাকালে সম্পৃক্ত করার অভীপ্সায় শিল্পের উপযোগিতাকে-দায়কে মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে জীবনের শেষান্ত পর্যন্ত সুস্থির থাকেন।কী এক বিস্ময়কর যোগ্যতায় শিল্পের দায়-মানুষের দায় কোনোটাই টাল খায় না তাঁদের সৃষ্টিকর্মে।বরঞ্চ দু’টিতে মিলেমিশে ভুখা,নাঙা,অত্যাচারিত,শোষিত,অধিকারবঞ্চিত মানুষের উত্থানের জন্য কালজয়ী প্রেরণা সৃষ্টি করে – সৃষ্টি হয় উঠে দাঁড়াবার কাব্য।
এই একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনার উন্মেষ সদ্য প্রয়াত বাংলা ভাষার,বাংলাদেশের,বাঙালীর জনপ্রিয় কবিদের অন্যতম কবি সমুদ্র গুপ্ত’র সদ্য প্রকাশিত”কবিতা সমগ্র”পাঠান্তে।অভিনব ও মূল্যবান এই সমগ্রে ১৯৭৭-২০০৮ পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর ১৩টি কাব্যগ্রন্থ ও অগ্রন্থিত কবিতাসমূহ পাঠ শেষে বলতে পারি দেশ-জাতি-ইতিহাসের প্রকৃত চর্চা সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন।এই সচেতনতার স্ফুরণ যেমন পায় তাঁর কবিতায় তেমন পায় তাঁর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে।
সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের স্বরূপ বুঝবার জন্য প্রখ্যাত সাম্রাজ্যবাদ বিশেষজ্ঞ ইকবাল আহমাদ-এর বিশ্লেষণ স্মরণযোগ্য:”যে ভাবধারায় আপনার স্বার্থ নাই সেই ভাবধারার সম্মুখে আপনিও যখন নতি স্বীকার করেন তখনি বলিতে হইবে সেই ভাবধারার আধিপত্যবাদ কায়েম হইয়াছে।সাম্রাজ্যবাদের সাংস্কৃতিক প্রকাশ এমনই।”
আমাদের দেশে বাংলা সাহিত্যে -বিশ্ব সাহিত্যে এমন অনেক প্রগতিশীল,স্বনামধন্য,জনপ্রিয় কবি ছিলেন বা আছেন-যারা আধুনিকতা,উত্তরাধুনিকতা,মীথ চর্চা করে এমন এমন বিষয়-এমন এমন ঘটনা-এমন এমন ব্যক্তি পরম্পরা আমাদের সাহিত্যে (বিশেষ করে কবিতায়)আত্মীয়করণ করেছেন বা করে যাচ্ছেন।
মনোযোগী পাঠক বুঝতে পারেন উপস্থাপিত বিষয়
-স্থান-কাল-পাত্র সবকিছুই প্রকৃত সত্যের অনেকানেক দূরবর্তী। সমুদ্র গুপ্ত এই বিষয়ে এতো বেশি সচেতন ও সজাগ ছিলেন যে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারেন;
“কিংবদন্তীর নামে আমাদের ঘাড়ের ওপর চেপে আছে মিথ্যে ইতিহাস।”(মিথ্যে ইতিহাস)
তাঁর কবিতায় তিনি কি করতে চেয়েছেন-মানুষ ও কবি হিসাবে তিনি কি করতে চেয়েছিলেন সেটা তাঁর কাব্যগ্রন্থ১.রোদ ঝলসানো মুখ,২.স্বপ্নমঙ্গল কাব্য,৩.এখনো উত্থান আছে,৪.চোখে চোখ রেখে,৫.একাকী রৌদ্রের দিকে,৬.শেকড়ের শোকে,
৭.ঘাসপাতার ছুরি,৮.নদীও বাড়ীতে ফেরে,৯.ছড়িয়ে ছিটিয়ে সে পথ,১০.চলো এবার গাছে উঠি,১১.হাতে তুলে নিলে এই বাংলার মাটি রক্তে ভিজে যায়,১২.মাথা হয়ে গেছে পোকা শুধু ওরে,১৩.তাহলে উঠে দাঁড়াবো না কেন,নামকরণগুলি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়-তারুণ্যের দীপ্র চাঞ্চল্যের রোদ ঝলসানো মুখ নিয়ে তিনি এই ভুবনে এসেছিলেন – সেই আসার মধ্যে ছিল সমাজ বদলের সংকল্প;ছিল প্রেমের সৃষ্টি শীলতায় গভীর বিশ্বাস;ছিল বিপ্লবী হওয়ার স্বপ্ন;
“দিনের পরে সন্ধ্যা যেমন আসে
ঠিক সে রকম তোমার কাছে আমার যাওয়া আসা
চোখের মধ্যে সাগর ধরে রাখো
আমার শুধু আকাশ হয়ে মুখটা দেখে আসা
ঠিক আছে না বদলে গেছে,ভালোবাসার ভাষা।”
(ভালোবাসার ভাষা)
সেই শেকড় সম্পৃক্ত সংকল্প-প্রেম-বিপ্লবের স্বপ্ন কখনো কখনো তাঁকে শোকাক্রান্ত করলেও দার্শনিক ও আদর্শিক ভিত্তি স্বপ্নমঙ্গলের যাত্রী হয়ে
মেহনতি মানুষের সংগ্রামকে,তাদের ঐতিহ্যকে বুকে তুলে নিয়ে বহুজাতিক সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট পূঁজির মালিকদের চোখে চোখ রেখে ধিক্কার দিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াবার প্রেরণা যোগান।
“অধিক খাদ্য ফলাও বলে বাজিয়ে ঢোলক বাদ্য
সোনার ধানে বিষ মিশিয়ে করেছে অখাদ্য
আজ বুঝেছি চলার পথে
ভাটির দিকে যেতে যেতে
উথাল পাথাল নদী কেন হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়
দেশটা যেন পরের বাড়ী;আমরা থাকি ভাড়ায়।”
(দেশ যেন পরের বাড়ী)
তিনি না প্রেমিক-না বিপ্লবী ছিলেন না।শেষ পর্যন্ত মানুষের উঠে দাঁড়াবার কবি ছিলেন।আর এই বিশ্বাসে এতোটাই শাণিত ছিলেন যে,শেষ কাব্যগ্রন্থে পৃথিবীকে বিদায় জানানোর আগেই পৃথিবীর সকল প্রান্তের সকল দেশের খেটে খাওয়া মানুষকে সংগ্রামে আহবান করলেন;
“তাহলে উঠে দাঁড়াবো না কেন?”
উঠে দাঁড়াবার স্বপ্নমঙ্গল যাত্রায় আমরা তাঁর সহযাত্রী হবো।কবিকে অশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সূত্র: অনন্য স্বদেশ, ২০০৯